(হামজা আন্দ্রেস জর্জিসের The Divine Reality এবং ডা. শামসুল আরেফীন শক্তির কাঠগড়া বই অবলম্বনে)
১০. বিরোধী সাক্ষ্যগুলো সম্ভব নয়, কারণ সেগুলো
কুরআনের ঐশী রচয়িতা
সূচিপত্রঃ
১. সাক্ষ্যের জ্ঞানতত্ত্ব
২. হস্তান্তর অধিকার
৩. চাক্ষুস সাক্ষ্যের ব্যাপারে কিছু কথা.
৪. সেরা ব্যাখ্যার অনুমান
৫. যুক্তিপ্রমাণ গঠন
৬. মানবজাতির সামনে কুরআনের ভাষিক ও সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ
৭. কুরআনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সবচে ভালো অবস্থানে ছিল সপ্তম শতকের আরবেরা
৮. ব্যর্থ হলো সপ্তম শতকের আরবেরা
৯. কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য
১০. বিরোধী সাক্ষ্যগুলো সম্ভব নয়, কারণ সেগুলো প্রতিষ্ঠিত আবহ তথ্যকে বাতিল করে
১১. সুতরাং (১-৫ থেকে) কুরআন অননুকরণীয়,
১২. কুরআনের অননুকরণীয়তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা—কোনো আরব, অনারব, মুহাম্মাদ কিংবা আল্লাহ এর প্রণেতা
১৩. সেরা ব্যাখ্যা কুরআন আল্লাহর তরফ থেকে
১৪. বিকল্প অনুমান
১৫. মোদ্দা কথা
০. ভূমিকা
আকাশবাণী বা প্রত্যাদেশ হিসেবে কুরআন কতটুকু সত্যতা বহন করে, তা যাচাই করব এ-অধ্যায়ে। আগের অধ্যায়গুলোতে কুরআনের বেশ কিছু আয়াত এসেছে তথ্যসূত্র হিসেবে। তবে এখানে আমরা আল্লাহর কথার যুক্তিযুক্ত ভিত্তি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করব।
আমাদের বেশির ভাগ জ্ঞান কিন্তু অন্যের কথার ওপর নির্ভরশীল। জীবনে এমন অনেক সত্য আমরা স্বীকার করি, যেগুলো বেশির ভাগ সময়েই অন্য কারও কাছ থেকে শোনা। অ্যামাজনের গহিন জঙ্গলে যে আদিবাসীদের বসবাস তাদের কি কখনো দেখেছি আমরা? পাতার মধ্যে যে সালোকসংশ্লেষণ হয় সেটাই বা দেখেছি কজন?
কিংবা ধরুন সূর্য থেকে আসা অতি বেগুনি রশ্মি? অথবা আপনার আমার পাশে ঘুরঘুর করা জীবাণু? আপনার মাকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে এ বিষয়টা আরও খোলাসা করছি। একজন অপরিচিত মানুষ হিসেবে, আমার কাছে কীভাবে আপনি প্রমাণ করবেন, যাকে আপনি মা বলেন, তিনিই আপনাকে জন্ম দিয়েছেন? জানি প্রশ্নটা শুনতে খুব উদ্ভট লাগছে। কিন্তু সাক্ষ্যের মতো জ্ঞানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিককে স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে এই প্রশ্ন।
প্রশ্নটার উত্তরে আপনি বলতে পারেন, “আমার মা আমাকে তা-ই বলেছেন" "আমার জন্মসনদ আছে” “আমার বাবা বলেছেন, তিনি ওখানে ছিলেন” বা “আমার মায়ের হাসপাতালের নথি খতিয়ে দেখেছি"। কথাগুলো বৈধ; কিন্তু এগুলো সবই অন্যের কথার ওপর ভিত্তি করে। সংশয়ী মন তাতে তৃপ্ত না-ও হতে পারে। শেষ ভরসা হিসেবে 'ডিএনএ কার্ড' বা ভিডিও প্রমাণ এনে নিজের বিশ্বাসের পক্ষে দলিল পেশ করতে পারেন। কিন্তু কথা কী, আমাদের বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু এভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করে নিজের বাবা-মা'র ব্যাপারে নিশ্চিত হন না। ভিডিও দেখেও না। মা বলেছেন—তাই বিশ্বাস করি। প্রায় ৯৯.৯৯ ক্ষেত্রে এমনই বিষয়টা। আর ভিডিওতে দেখানো বাচ্চাটি যে আপনিই—তা-ই বা নিশ্চিত হলেন কীভাবে? সেটাও তো অন্যের কথা শুনে বিশ্বাস করতে হয়। ঠিক এখানেই জ্বলজ্বলে রূপে আবির্ভূত হয় সাক্ষ্যের মতো জ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।
জ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সেরা ব্যাখ্যা। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, বিবৃতি থেকে যুক্তিবিচারের মাধ্যমে ভিত্তি পায় আমাদের বেশির ভাগ বিশ্বাস। এরপর সেগুলোর পক্ষে খোঁজা হয় সেরা ব্যাখ্যা। আপনার মায়ের উদাহরণটি নিয়ে আসি আবার।
ধরুন, আপনার মা গর্ভাবস্থার একদম শেষ পর্যায়ে আছেন। ডাক্তারের দেওয়া প্রসবের তারিখ চলে গেছে গত মাসে। তো হঠাৎ তার পানি ভাঙা শুরু হলো। গৰ্ভস্থ পেশির সংকোচন শুরু হয়েছে। আপনার বাবা এবং উপস্থিত চিকিৎসা-কর্মী নিশ্চিতভাবে অনুমান করলেন প্রসব-ব্যথা এটা।
আরেকটি উদাহরণ দেখুন।
কয়েক বছর পরের ঘটনা। আপনার মা দেখলেন মেঝেতে একটা খোলা বিস্কুটের মোড়ক পড়ে আছে। আপনার মুখের চারপাশে, কাপড়ে বিস্কুটের গুড়ো লেগে আছে। তিনি বুঝলেন, মোড়ক খুলে নিজেই বিস্কুট খেয়েছেন আপনি।
ওপরের দুটো উদাহরণে যে-সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে, তা অনিবার্য সত্য বা তর্কাতীত নয়। কিন্তু উপস্থিত সব তথ্য বিবেচনায় ওগুলোই ঘটনাগুলোর সেরা ব্যাখ্যা। এধরনের চিন্তাধারা সেরা ব্যাখ্যার অনুমান নামে পরিচিত।
এই দৃশ্যপটের অবতারণা কেন করলাম?
কুরআন যে আরবি ভাষার এক অননুকরণীয় প্রকাশ তা প্রমাণে, এই উদাহরণগুলোতে যে-ধারণা ও মূলনীতি পোরা আছে, তা ব্যবহার করব। অনুনকরণীয় বলতে বোঝানো হচ্ছে, কুরআনের ভাষিক ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো নকল বা অনুকরণ করা অসম্ভব। ভাষা-অলংকারের বেলায় এর সাহিত্যিক রূপ ও ধরন একেবারে স্বতন্ত্র। তো, আমার উদাহরণগুলোর সাথে এর যোগসূত্র কী?
নিচের রূপরেখাটি খেয়াল করুন:
সপ্তম শতকে আরবে নবি মুহাম্মাদের কাছে অবতীর্ণ হয় কুরআন। সময়টা তখন সাহিত্যিক ও ভাষিক নিপুণতার স্বর্ণযুগ নামে পরিচিত। মাতৃভাষায় অনুপমভাবে নিজেদের প্রকাশ করত আরবেরা। নিজেদের মাঝে কোনো কবির আবির্ভাবে গর্বে ফেটে পড়ত তারা। কবিতা ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞান। কাব্যিক প্রতিভা আর ভাষিক মুনশিয়ানাই ছিল তাদের জীবন-জীবিকা। ওটা ছাড়া যেন দম বন্ধ হয়ে আসত তাদের। কিন্তু সেই তাদের সামনে যখন কুরআনের আয়াত পাঠ করা হতো, ওরা দম নেওয়ার কথা ভুলে যেত। ভাষা হারিয়ে ফেলত। বিবশ হয়ে যেত। ওদের বড় বড় কবিদের নীরবতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষের মতো নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ওরা। কুরআনের বয়ানের মতো কোনো কিছু বানানো তো দুরের কথা, দিন দিন অবস্থার অবনতিই হয়েছে শুধু। সেসময়ের বাঘা বাঘা কবিদের কুরআন চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে, এর অনন্য ভাষিক ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য অনুকরণে কিছু রচনা করতে। কিন্তু তারা নাকানিচুবানি খেয়েছে। কোনো কোনো বিশিষ্ট কবিরা কুরআনকে মেনে নিয়েছিলেন আল্লাহর কথা হিসেবে। কিন্তু বেশির ভাগ লোকই বেছে নিয়েছিল সম্পর্ক ছিন্ন, মারামারি, নিপীড়ন আর অপ-প্রচারের পথ। যুগে যুগে বিশেষজ্ঞরা চেয়েছেন কুরআনকে চ্যালেঞ্জ করতে। কিন্তু তারাও নতস্বরে বলেছেন কুরআন অননুকরণীয়। ভাষা-সাহিত্য পণ্ডিতেরা কেন বিফল হয়েছেন, দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা।
আচ্ছা, একজন অনারব বা আরবি ভাষায় অদক্ষ কেউ কী করে কুরআনের অননুকরণীয়তার কদর বুঝবে? এখানেই আমাদের প্রয়োজন পড়ছে সাক্ষ্যের।
অতীত-বর্তমানের আরবিভাষা বিশেষজ্ঞদের থেকে লিখিত ও মৌখিক সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানের ভিত্তিতে মেনে নেওয়া হয়েছে কুরআনের অননুকরণীয়তা। স্বভাবতই তখন প্রশ্ন আসে, কে তা হলে এর প্রণেতা? এখানে এসে সাক্ষ্য থেমে যায়। শুরু হয় অনুমান। সেরা ব্যাখ্যার অনুমানটিকে বুঝতে হলে আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কুরআনের অননুকরণীয় প্রকৃতির সম্ভাব্য যুক্তিগ্রাহ্য কারণগুলোকে। কুরআন হয় কোনো আরব লিখেছেন, নয় কোনো অনারব, মুহাম্মাদ (সাঃ) অথবা স্বয়ং আল্লাহ। এ অধ্যায়ে উপরোক্ত সম্ভাবনাগুলো নিয়ে যেসব আলোচনা আসবে, তাতে বোঝা যাবে, কোনো আরব-অনারব বা মুহাম্মাদ (সাঃ) যদি এর রচয়িতা হতেন, তা হলে এর অনুকরণ সম্ভব হতো। যেহেতু হয়নি, তার মানে আল্লাহকে এর রচয়িতা হিসেবে মেনে নেওয়া সেরা ব্যাখ্যার অনুমান। উপরোক্ত ভূমিকার মূল অনুমান জ্ঞানের এক বৈধ উৎস সাক্ষ্য। এবং বাস্তবতা সম্বন্ধে উপসংহার টানতে গেলে হেতুবাক্য বা পরিলক্ষিত ঘটনা থেকে সিদ্ধান্তে আসার প্রক্রিয়া যৌক্তিক এবং যথাযোগ্য পদ্ধতি। এই অধ্যায়টি আপনাদের সাক্ষ্যের জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে পরিচয় করাবে তুলে ধরবে সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানগ্রহণের যৌক্তিকতা। উপযুক্ত ব্যাখ্যা অনুমানের কার্যকারিতার বিষয়টিও ফুটিয়ে তুলবে। কুরআনের অননুকরণীয়তার বেলায় এ-দুটো ধারণা খাটাবে। এই অধ্যায়ে আমরা আরও দেখব, যেহেতু কেউ কুরআনের অনুকরণ করতে পারেননি, কাজেই এর রচয়িতা হিসেবে আল্লাহই সেরা ব্যাখ্যা। আরবি ভাষা সম্বন্ধে কোনো অভিজ্ঞতা এমনকি ন্যূনতম জ্ঞান না থাকলেও এটা বুঝতে পারবেন পাঠকেরা।
১. সাক্ষ্যের জ্ঞানতত্ত্ব
অধ্যায় ১২-তে (The Divine Reality, ch 12) আমরা স্বল্প পরিসরে আলোচনা করেছি জ্ঞানের উৎস হিসেবে সাক্ষ্যের অনিবার্যতা এবং মৌলিকতা নিয়ে। জ্ঞানতাত্ত্বিকেরা এ সম্বন্ধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন। এগুলোর মাঝে আছে সাক্ষ্য কখন প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট হয়, সাক্ষাভিত্তিক জ্ঞান কি জ্ঞানের অন্য কোনো উৎসের ওপর ভিত্তি করে? নাকি এটা মৌলিক। জ্ঞানতত্ত্বের এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা কিংবা সুরাহা করার পরিসর নেই এখানে। তবে এ বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে পাঠকদের একটা ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। তা হলে তারা বুঝতে পারবেন, সাক্ষা জ্ঞানের এক বৈধ উৎস।
১.১ সাক্ষ্য কি মৌলিক?
অধ্যায় ১২-তে সাক্ষাভিত্তিক জ্ঞানগ্রহণের কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছিলাম আপনাদের সামনে। অন্যের কথার ওপর আমাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক নির্ভরতাকে উন্মোচন করে দিয়েছে উদাহরণগুলো। লেখা-প্রসঙ্গে স্পষ্টভাষী নাস্তিক লরেন্স ক্রাউসের সঙ্গে আমার এক উন্মুক্ত আলাপের কথা মনে পড়ল। পর্যবেক্ষণ যে জ্ঞানের একমাত্র উৎস নয় সেদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, এ সম্বন্ধে তার পূর্বানুমানটা কী তা বের করা। সাক্ষ্যের বিষয়টা তুলে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি বিবর্তন বিশ্বাস করেন কি না। তিনি বললেন, করেন। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, এর সব পরীক্ষা তিনি নিজে করেছেন কি না। তিনি না-সূচক উত্তর দিয়েছিলেন।[1] কোনো কিছু আমরা কেন বিশ্বাস করি, সে সম্বন্ধে তার অনুমানের এক গুরুতর দিক উন্মোচন করেছে তার স্বীকারোক্তি। আমাদের অনেকের অবস্থাও এমন। আমাদের বেশির ভাগ বিশ্বাসই গড়ে ওঠে অন্যের কথার ওপর ভিত্তি করে। কেবল বৈজ্ঞানিক ভাষার মোড়কে আছে বলেই সেগুলো সবই নিজস্ব পর্যবেক্ষণলব্ধ কিছু নয়।
এই তো, কিছুদিন আগেও জ্ঞান অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে দেখা হতো না সাক্ষ্যকে। কিন্তু এ বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা আর প্রকাশনা ভেঙে দেয় জ্ঞানতাত্বিক নীরবতা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সি এ জে কোডির ‘টেস্টিমনি: আ ফিলোসফিক্যাল ডিসকাশন’। সাক্ষ্যের বৈধতার ব্যাপারে যুক্তি দেখিয়েছেন কোডি৷ সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানগ্রহণ সম্বন্ধে ডেভিড হিউমের খণ্ডিতবাদী মতেরও সমালোচনা করেছেন তিনি। খণ্ডিতবাদী তত্ত্ব বলে, উপলব্ধি, স্মৃতিশক্তি এবং দৃষ্টান্ত থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মতো জ্ঞানের অন্যান্য উৎস সাক্ষ্যের ন্যায্যতার প্রমাণ দেয়। অর্থাৎ, প্রমাণ হিসেবে সাক্ষ্যের নিজস্ব কোনো মূল্য নেই। অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞানের মাধ্যমে একে ন্যায্য প্রমাণ হতে হবে।
অন্যদিকে সাক্ষ্য সম্বন্ধে কোডির বিবরণ মৌলিক। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, পর্যবেক্ষণের মতো জ্ঞানের অন্য কোনো উৎসের সাহায্য ছাড়াই সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানের ন্যায্যতা প্রমাণিত। সাক্ষ্যের এই বিবরণ খণ্ডিতবাদ-বিরোধী তত্ত্ব নামে পরিচিত। হিউমের কর্মপন্থার সমালোচনা করে খণ্ডিতবাদী তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন তিনি।
হিউম মূলত খণ্ডিতবাদী তত্ত্বের মূল প্রবক্তা হিসেবে নাম করেছিলেন এনকোয়ারি কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডাস্ট্যান্ডিং বইতে ‘অন মিরাকল্স' নামে একটা প্রবন্ধ লিখে। সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানকে তিনি একেবারে নাকচ করেননি; বরং এর কিছু গুরুত্বের কথাও উল্লেখ করেছেন:
“মানুষের সাক্ষ্য থেকে যা নিরূপণ করা হয়, বিচারবিশ্লেষণের আর কোনো কিছু এত সহজলভ্য, এত উপযোগী, এমনকি মানবজীবনের জন্য এত প্রয়োজনীয় নয়…।" [2]
হিউম যুক্তি দেখিয়েছেন, সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞান এবং আমাদের সামগ্রিক অভিজ্ঞতার মাঝে থাকা মিলের ওপর নির্ভর করে সাক্ষ্যের ওপর আমাদের আস্থা। ঠিক এ জায়গাটাতে হিউমের কর্মপন্থার ছিদ্র পেয়েছেন কোডি। তার সমালোচনা কেবল নিচের যুক্তিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং একে তিনি আরও বিস্তৃত করেছেন। এ থেকে তার গোটা যুক্তির শক্তিমত্তাও বোঝা যায়।
কোডি যুক্তি দেখিয়েছেন, সামগ্রিক পর্যবেক্ষণের কথা বলে হিউম আসলে এক দুষ্টচক্রকে ডেকে এনেছেন। হিউম দাবি করেছেন, কেউ যে-জ্ঞানের সাক্ষ্য দেয়, তা যদি পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের সঙ্গে মেলে, কেবল তবেই তার ন্যায্যতা প্রমাণিত। এখানে পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য বলতে হিউম ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণকে বোঝাননি; বুঝিয়েছেন সামগ্রিক পর্যবেক্ষণকে। কোডি যুক্তি দেখিয়েছেন, সব সময় আমরা এমন সাধারণীকৃত ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করতে পারি না। এখানেই বের হয়ে আসে দুষ্টচক্রটা। কারণ, কেউ কী পর্যবেক্ষণ করেছেন, সেটা কিন্তু আমরা কেবল তার সাক্ষ্য থেকেই জানতে পারি। শুধু নিজের সরাসরি অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করলে তা যথেষ্ট হবে না। কারণ, সে জ্ঞান হবে খুবই সীমিত, কোনো কিছুর ন্যায্যতা প্রমাণে অনুপযুক্ত— কিংবা অন্ততপক্ষে খুবই সামান্য। আর তাই খণ্ডিতবাদী তত্ত্ব ত্রুটিপূর্ণ। সাক্ষ্যকে পর্যবেক্ষণের মতো জ্ঞানের অন্যান্য উৎসের মাধ্যমে ন্যায্য প্রমাণিত হতে হবে—এমন কথা বলে এই মতবাদ আসলে যেটাকে নাকচ করতে চায়, সেটাকেই মেনে নেয় সাক্ষ্যের মৌলিক রূপকে। মূল যে-কারণ এই বিষয়ের নিশ্চয়তা দেয় তা হচ্ছে আমাদের সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ কী তা জানতে হলে আপনাকে অন্য লোকের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে, যেহেতু আমরা সেগুলো নিজেরা পর্যবেক্ষণ করিনি।
১.২ অভিজ্ঞদের ওপর নির্ভর করা
আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। অথচ গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যগুলো সম্বন্ধে অভিজ্ঞরা যা বলেছেন, তার ওপর যদি আস্থা না রাখতাম, তা হলে কিন্তু বিজ্ঞান এতদূর এগোতে পারত না। উদাহরণ হিসেবে বিবর্তনকেই ধরুন। রিচার্ড ডকিন্সকে যদি সব গবেষণা নিজেকেই করতে হতো এবং সব পরীক্ষা নিজের চোখেই দেখতে হতো, তা হলে এর সত্যতা এত জোরের সঙ্গে বলতে পারতেন না তিনি। কিছু কিছু পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষা তিনি নিজে পুনরায় করতে পারলেও, অনেক তথ্যের জন্যই কিন্তু তাকে নির্ভর করতে হয়েছিল অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কথার ওপর। জ্ঞানের এই শাখার বিস্তৃতি এত বিশাল—সবকিছু নিজেরা খতিয়ে দেখা অসম্ভব। সুতরাং, এ ধরনের ধ্যানধারণা পোষণ করে বসে থাকলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্ভব হতো না।
ওপরের উদাহরণটি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নের মুখোমুখি করাচ্ছে আমাদের সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞান যদি কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির কথার ওপর ভিত্তি করে হয় তখন কী হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা সবাই অভিজ্ঞ নই। আর তাই সময়ে সময়ে অন্যদের সাক্ষ্য আমাদের গ্রহণ করতে হয়। দর্শনের অধ্যাপক ড এলিজাবেথ ফ্রিকার বিষয়টাকে খুলে বলছেন:
“কখনো কখনো সম্মানের সঙ্গে অন্যের সাক্ষ্য মেনে নেওয়াটা যৌক্তিক; না নেওয়াটা অযৌক্তিক। ব্যক্তির শিক্ষাদীক্ষা, তার মননগত এবং শারীরিক প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতার কারণে এটা প্রয়োজন। সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে, সবাই যে একই স্তরের হবে তাও কিন্তু বাস্তব নয়। কেউ তার চেয়ে সেই বিষয়ে ভালোও জানতে পারেন। আমি যে উড়তে পারি না, বা এক সপ্তাহ না ঘুমালে আমার কাজেকর্মে যে ক্ষতি হবে, কিংবা আমি যা জানতে চাই তার সবকিছুই যে নিজে নিজে খুঁজে পাই না, এসব নিয়ে আমি যৌক্তিকভাবে আফসোস করতে পারি। কিন্তু আমার মননগত ও শারীরিক সীমাবদ্ধতা যেহেতু নির্ধারিত পরিমাপের, তাই অন্যের কথায় আমার বর্ধিত কিন্তু বিচক্ষণ আস্থা, তা থেকে অর্জিত বিপুল জ্ঞানগত এবং অন্যান্য ঐশ্বর্য নিয়ে আফসোসের অবকাশ নেই কোনো।”[3]
১.৩ আস্থা
সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানগ্রহণের আলোচনায় এবারে বিশ্বস্ততার বিষয়টি চলে আসে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে কারও বিশেষ পাণ্ডিত্যের কারণে তার কথা মেনে নিতে, একদিকে যেমন তার ওপর ভরসা করতে হয়, অন্যদিকে তার বিশ্বস্ততা যাচাইয়ে আমাদেরও হতে হয় বিশ্বস্ত।
সাক্ষ্যের প্রকৃতি ও বৈধতার আলোচনা এখন সরে গেছে খণ্ডিতবাদী ও খণ্ডিতবাদ বিরোধী ভাবকাঠামো থেকে। দর্শনের অধ্যাপক কেথ লেহরার যুক্তি দেখিয়েছেন, সাক্ষ্যের ন্যায্যতার প্রমাণ এ দুটোর কোনোটাই না; বরং আস্থা। তার কথা, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে সাক্ষা থেকে সঠিক জ্ঞান পাওয়া গেলেও, সব পরিস্থিতিতে তার হয় না। [4]
তার মতে,
“সাক্ষ্য দেওয়া তথ্যদাতা যদি বিশ্বস্ত হন, তা হলে (সাক্ষ্য) নিজেই প্রমাণ হিসেবে গণ্য। না হলে সাক্ষ্য নিজে থেকে কোনো প্রমাণ গঠন করে না।"[5]
সাক্ষাদানকারী ব্যক্তিকে “বিশ্বস্ত হিসেবে একেবারে অভ্রান্ত হতে হবে"[6] এমন নয় ব্যাপারটা। কিন্তু “সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তি যা গ্রহণ করেন এবং প্রচার করেন, সে ব্যাপারে তাকে অবশ্যই বিশ্বস্ত হতে হবে।"[7] কারও কথাকে জ্ঞান হিসেবে নিতে হলে কেবল বিশ্বস্ততাই যথেষ্ট নয় বলে স্বীকার করেছেন লেহরার। তিনি জোর দিয়ে। বলেছেন, ব্যক্তির বিশ্বস্ততাকে অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে। এবং আমাদের এই যাচাইয়ের বেলায় আমাদেরও হতে হবে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।[8] কোনো সাক্ষ্যভিত্তিক তথ্য যাচাইয়ে মূল ভূমিকা পালন করে কোনো বিষয়ের আবহ-জ্ঞান, জ্ঞানের সেই নির্দিষ্ট শাখায় অন্যান্যদের সাক্ষ্য, সাথে ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক অভিজ্ঞতা।
লেহরার বলেন, অন্যদের বিশ্বস্ততা মূল্যায়নের বেলায় আমরা যদি বিশ্বস্ত হতে চাই, আমাদের তা হলে দেখতে হবে এর আগে যাচাইয়ের বেলায় আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো—সেখানে আমরা কি ঠিক ছিলাম নাকি ভুল। তবে কোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য যে-নির্ভরযোগ্য না, এটাও সাধারণত আমরা জানি সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে অন্যের সাক্ষ্য থেকে।[9] কাজেই এখানে একটা দুষ্ট চক্র ওঁত পেতে আছে বলে মনে হতে পারে। কারণ, কারও সাক্ষ্য যাচাইয়ে আমরা নির্ভর করছি অন্যের সাক্ষ্যের ওপর। তবে লেহরার একে বলতে চান অনেকটা “পুণ্যচক্র” হিসেবে। কীভাবে? দুটো উত্তর দিয়েছেন তিনি
“প্রথমত, যুক্তিগ্রাহ্যতা বা বিশ্বস্ততার কোনো সম্পূর্ণ তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন আমরা সেই তত্ত্বকে গ্রহণ করলে ঠিক কাজ করব বা বিশ্বস্ত আচরণ করব। কাজেই তত্ত্বটাকে নিজের ওপর খাটিয়েই ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন আমরা এটা গ্রহণ করে ঠিক কাজ করব বা বিশ্বস্ত আচরণ করব। দ্বিতীয়ত, এবং আগেরটির মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ, অতীতে আমরা কী গ্রহণ করেছি তা থেকে উদ্ভূত হতে হবে আমাদের বিশ্বস্ততাকে। অন্যের সাক্ষ্য থেকে কী গ্রহণ করেছি সেটাও বিবেচনায় থাকবে সেখানে। নির্দিষ্ট যে-জিনিস আমরা গ্রহণ করেছি এবং কোনো কিছু গ্রহণ করায় আমাদের সাধারণ বিশ্বস্ততা—এ দুয়ের মাঝে এক ধরনের পারস্পরিক সমর্থন আছে। সাধারণ এই বিশ্বস্ততার মাঝে অবশ্য যে-নির্দিষ্ট জিনিসগুলো আমরা গ্রহণ করেছি সেগুলোও থাকবে। যেসব জিনিস আমরা গ্রহণ করি, সেগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক এই সমর্থনের ফলস্বরূপ নির্ধারিত হয় কোনো কিছু গ্রহণ করায় আমাদের বিশ্বস্ততা।" [10]
২. হস্তান্তর অধিকার
কিন্তু অন্যের অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করায় কীভাবে আমরা আস্থা অর্জন করব, সে প্রশ্নটি থেকেই যায় লেহরারের আলোচনা থেকে। অধ্যাপক বেনিয়ামিন ম্যাকমাইলার বেশ আকর্ষণীয় এক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন এ প্রশ্নের জবাব পেতে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, সাক্ষ্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক সমস্যাকে “হস্তান্তরের জ্ঞানতাত্ত্বিক অধিকার ব্যাখ্যার সমস্যা হিসেবে পুনর্নির্মাণ” করা যায়।[11]
ম্যাকমিলারের মন্তব্য, শ্রোতার কাছে যদি বক্তার দিকে চ্যালেঞ্জ হস্তান্তরের অধিকার থাকে, তা হলে সাক্ষ্যের সমস্যাটি নতুনভাবে গড়া যায়। এজন্য প্রয়োজন উভয়পক্ষের নিজ নিজ দায় স্বীকার। বক্তাকে তার সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞান প্রচারের দায় নিতে হবে। শ্রোতাদেরও জানা থাকতে হবে, তারা বক্তার দিকে চ্যালেঞ্জ হস্তান্তর করতে পারেন। [12]
বক্তা (বা লেখকের) প্রতি চ্যালেঞ্জ হস্তান্তরের এই অধিকার প্রয়োগ করে বিশ্বস্ততা গড়ে তোলা যায়। এসব চ্যালেঞ্জের সংগতিপূর্ণ জবাব দেওয়া গেলে আস্থা বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। নিচের উদাহরণটি খেয়াল করুন।
মনে করুন, ভাষাবিজ্ঞানের কোনো অধ্যাপক দাবি করলেন কুরআন নকল করা সম্ভব নয়। তিনি কুরআনের বাগ্ অলংকার, এর স্বতন্ত্র ভাষিক রূপ ও ধরনের বর্ণনা দিলেন। শ্রোতারা এবার দায়িত্বভার নিয়ে অধ্যাপককে চ্যালেঞ্জ করলেন। তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন: আপনি কি আমাদের কুরআন থেকে আরও উদাহরণ দিতে পারেন? কুরআনের ধরন নিয়ে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা কী বলেছেন? যেসব পণ্ডিত আপনার মতের বিরোধিতা করেন, তাদের মতামতকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনি? কুরআনের ঐতিহাসিক পটভূমিগত তথ্যের আলোকে এটা কীভাবে আপনার দাবিকে সমর্থন করছে? অধ্যাপক এসব প্রশ্নের সংগতিপূর্ণ জবাব দিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তুললেন আস্থা।
৩. চাক্ষুস সাক্ষ্যের ব্যাপারে কিছু কথা
এতক্ষণ যাবৎ আমাদের আলোচনা হয়েছে জ্ঞানের সাক্ষ্যভিত্তিক প্রচার নিয়ে। কোনো ঘটনা বা অপরাধ নিজ চোখে দেখে তা হুবহু বর্ণনা করা বিষয়ে নয়। চাক্ষুস সাক্ষ্য সম্বন্ধে অনেক গবেষণাপত্র, লেখালেখি আছে। ওসব গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা এ অধ্যায়ের উদ্দেশ্য নয়। তবে চাক্ষুস সাক্ষ্য কতটা নির্ভরযোগ্য তা নিয়ে পণ্ডিত মহলে সংশয় আছে যেহেতু, কাজেই সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞান-সঞ্চারের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। আমাদের ক্ষণকালীন স্মৃতির খুঁত, মানসিক প্রভাব, কোনো ঘটনা হুবহু বলতে পারার সীমাবদ্ধতা সহ বেশ কিছু কারণে আমাদের চাকুস সাক্ষ্যে উনিশ-বিশ হতে পারে। কিন্তু সাক্ষাভিত্তিক জ্ঞান বা ধারণাগুলো এ ধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত। কারণ, সাধারণত কোনো বিষয় নিয়ে একাধিকবার গভীর পড়াশোনা, দীর্ঘসময় ধরে গবেষণা করে নিজের মাঝে আত্মস্থ করার পরই কেবল জ্ঞান অর্জিত হয়।
বিষয়টা আমাদের আলোচনাকে সামান্য অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নিয়ে গেলেও বেশ ফলপ্রদ হবে সেটা। ডেভিড হিউম অলৌকিকতার ওপর একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, অলৌকিক ঘটনার পক্ষে একমাত্র প্রমাণ চাক্ষুস সাক্ষ্য। তার কথা ছিল, চাক্ষুস সাক্ষীদের ভুল করার শঙ্কা যদি অলৌকিক ঘটনাটা ঘটার সম্ভাবনার চেয়ে কম হয়, কেবল তখনই আমরা অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতে পারি। [13]
মাত্র একজনের চাক্ষুস সাক্ষ্যের ব্যাপারে সন্দেহ আছে বটে। তবে একাধিক সাক্ষা থাকলে সেই চাক্ষুস সাক্ষ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়াই যায় (ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রে এ ধারণাটি পরিচিত 'তাওয়াতুর' নামে)।
যদি বহু সংখ্যক (বা যথেষ্ট বড় সংখ্যক) এমন স্বতন্ত্র সাক্ষী থাকে, যারা কিনা প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধারা পরম্পরায় সাক্ষ্যটি সঞ্চার করেছেন, এবং তাদের অনেকেরই যদি নিজেদের মধ্যে কখনো দেখাসাক্ষাৎ না হয়, তা হলে সেই সাক্ষ্যকে কেউ যদি বাতিল করে দেন, সেটা তা হলে যুক্তিসিদ্ধ হবে না। হিউম নিজেই এ ধরনের চাক্ষুস বর্ণনার জোরের কথা স্বীকার করেছেন। বলতে চেয়েছেন, সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানের বর্ণনা যদি একাধিক উৎস থেকে আসে, তবে অলৌকিকতা প্রমাণ সম্ভব হতে পারেঃ
অলৌকিক ঘটনা কখনো প্রমাণ করা যাবে না। কাজেই কোনো ধর্মব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে একে ব্যবহার করা যাবে না—একথার সীমাবদ্ধতার দিকে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কারণ, আমি স্বীকার করি, মানুষের সাক্ষ্য থেকে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা প্রমাণ হতে পারে—যদিও লিপিবদ্ধ ইতিহাসে এরকম কিছু পাওয়া অসম্ভব। তো ধরুন, সব ভাষার সব লেখক একমত হলেন, ১৬০০ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুর থেকে ৮ দিন যাবৎ গোটা পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে ছিল। মনে করুন, এই অসাধারণ ঘটনাটির বর্ণনা আজও মানুষের মনে সজীব। সব সফরকারী, যারা বিদেশ থেকে ফেরেন, সামান্যতম উনিশ-বিশ, কিংবা বৈপরীত্য ছাড়াই ঘটনাটি বর্ণনা করেন। সেক্ষেত্রে, ঘটনাটিকে সন্দেহ করার বদলে, আমাদের বর্তমান দার্শনিকদের একে প্রমাণ হিসেবে মেনে নিতে হবে…। [14]
আমাদের এ অধ্যায়ের মূল আলোচনা সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানসঞ্চার নিয়ে; কোনো ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষ্য নিয়ে নয়। এ দুয়ের মাঝে ধারণাগত পার্থক্য খুব স্পষ্ট। উভয় ধরনের সাক্ষ্যের পার্থক্যটি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হলো বিষয়টি।
তো মূল কথা, জ্ঞানের এক অনিবার্য উৎস সাক্ষ্য। এ ধরনের জ্ঞান ছাড়া বর্তমানে লক্ষণীয় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্ভব হতো না। জ্ঞানের অনেক প্রতিষ্ঠিত বিষয় পরিণত হতো সংশয়বাদীর খেয়ালি চিন্তায়। পৃথিবীকে যারা সমতল ভূমি বলেছিলেন একসময়, তাদের কথাকে আমাদের উড়িয়ে দেওয়ার ন্যায্যতা প্রমাণ হতো না কখনো।
সাক্ষ্যকে জ্ঞানের স্তরে পৌঁছাতে হতে হলে, অন্যের বিশ্বস্ততা যাচাইয়ে আমাদেরও হতে হবে বিশ্বস্ত। সাক্ষীর দিকে চ্যালেঞ্জ হস্তান্তরের দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের দাবির সঙ্গে কিছু সত্যের সংযোগ আছে কি না তা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। এগুলোর মধ্যে থাকতে পারে অন্যান্য সাক্ষ্য বা আবহ তথ্য।
৪. সেরা ব্যাখ্যার অনুমান
ভাবনাচিন্তা করার এক অমূল্য উপায় সেরা ব্যাখ্যার অনুমান। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক উপাত্ত এবং/অথবা আবহ জ্ঞানকে সংগতিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয় এখানে। যেমন ধরুন, ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন আপনার কেমন লাগছে। আপনি বললেন, নাক বন্ধ, গলায় ব্যথা বা জ্বলে, হাঁচি, ঘড়ঘড় শব্দ হয়, কফ আসে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে, জ্বর, মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা, ক্লান্তি ইত্যাদি। আপনার দেওয়া তথ্য বিচার করে ডাক্তার চেষ্টা করেন আপনার শরীর কেন খারাপ সে সম্বন্ধে সবচে উপযুক্ত কারণ জানাতে। সেই সাথে চিকিৎসা-বিজ্ঞানসংক্রান্ত তার অর্জিত জ্ঞানের আলোকে তিনি বুঝলেন, আপনার লক্ষণগুলো সাধারণ ঠান্ডা-কাশির সঙ্গে সবচে ভালো মেলে। তিনি অনুমান করলেন সেরা ব্যাখ্যা।
হেতুবাক্য থেকে সিদ্ধান্তে আসার বাস্তবিক ও অপরিহার্য ভূমিকা ব্যাখ্যা করে ইতিহাস ও দর্শনের অধ্যাপক পিটার লিপটন বলছেন,
“ডাক্তার অনুমান করলেন রোগীর হাম হয়েছে। কারণ, সামনে থাকা প্রমাণ সাপেক্ষে এটাই সবচে উপযুক্ত ব্যাখ্যা। জ্যোতির্বিদ অনুমান করলেন, নেপচুনের গতির অস্তিত্ব। ইউরেনাসের মধ্যে যে-বিচ্যুতে নজরে আসে, ওটাই তার সেরা ব্যাখ্যা সবচে উপযুক্ত ব্যাখ্যার অনুমান আমাদের সিদ্ধান্তজাত চর্চাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাখ্যামূলক বিবেচনা। আমাদের কাছে থাকা উপাত্ত এবং বিশ্বাসের আলোকে আমরা অনুমান করি, যদি সত্য হয়. এসব উপাত্ত থেকে পাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাখ্যাগুলো থেকে কোনটা সবচে উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেবে…।" [15]
আমাদের হাতে থাকা উপাত্তের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়েই আমরা পেতে পারি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যাগুলোর মাঝে কোনটা সেরা তা আলাদা করে, তাদের সম্ভাব্যতা; এবং এদের মধ্যে পার্থক্যসূচক অন্যান্য উপাত্ত। লিপটন বলছেন,
“প্রথমে আমরা সম্ভাব্য ব্যাখ্যাগুলোকে বিবেচনা করি। এরপর ওগুলোর মাঝে পার্থক্য সূচিত করে এমন উপাত্ত খুঁজি, অন্য কেউ যদি অধিকতর ভালো কোনো বিকল্প ব্যাখ্যা দিতে পারেন, তা হলে আগের অনুমান বাতিল হয়ে যেতে পারে, অথচ দেখা যাবে প্রমাণ হয়তো কিছুই বদলায়নি।” [16]
প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাখ্যাগুলোর মাঝে কোনটা সবচে বেশি যুক্তিসিদ্ধ তা যাচাই করতে অতিরিক্ত উপাত্তগুলোই একমাত্র পথ নয়; একে হতে হয় সবচে সরল। তবে সরলতা এবং সর্বব্যাপকতার মাঝে একটা সতর্ক ভারসাম্য থাকতে হয়। সর্বব্যাপকতা মানে ব্যাখ্যাটির থাকতে হবে ব্যাখ্যামূলক জোর এবং ব্যাপ্তি। বিসদৃশ বা স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণসহ সব উপাত্তের বর্ণনা দিতে হবে ব্যাখ্যাটিকে।
কোনো ব্যাখ্যা সর্বব্যাপক কিনা তা যাচাইয়ের আরেকটি মাপকাঠি হচ্ছে, আগে যেসব উপাত্ত বা পর্যবেক্ষণগুলো অজানা ছিল, অপ্রত্যাশিত ছিল, বা ব্যাখ্যা করা অসাধ্য ছিল, সেগুলো ব্যাখ্যা করতে পারছে কি না। সেরা ব্যাখ্যা যাচাইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হচ্ছে আমাদের শিক্ষাদীক্ষার নিরিখে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাখ্যাগুলোর তুলনায় একে হতে হবে সম্ভাব্য সবচে সত্য। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির দার্শনিক গিলবার্ট এইচ হার্মান জোর দিয়ে বলেন, যখন বিকল্প ব্যাখ্যা থাকবে, কাউকে তখন “অনুমানটিকে ন্যায্য প্রমাণ করার আগে বাকি সব বিকল্প রূপতত্ত্বগুলোকে বাতিল করতে পারতে হবে। প্রাপ্ত হেতুবাক্য থেকে কোনো একটি রূপতত্ত্ব অন্য রূপতত্ত্বগুলো থেকে প্রমাণের পক্ষে ‘অধিকতর ভালো ব্যাখ্যা দেবে। আর এভাবেই কেউ অনুমান করেন যে, প্রদত্ত রূপতত্ত্বটি সত্য।[17]
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, যুক্তিবিচারে সেরা ব্যাখ্যার অনুমান অপরিহার্য। যাবতীয় সংশয়ও মুছে ফেলতে পারে এটা। আমাদের হাতে যদি সীমিত কিছু উপাত্ত থাকে, আর নির্দিষ্ট কিছু ব্যাখ্যা থাকে, তা হলে সেরা ব্যাখ্যাটি বেশ কিছু পরিমাণে নিশ্চিত। কারণ, এরচে ভালো কোনো ব্যাখ্যার সম্ভাবনা নেই। আর বিকল্প ভালো কোনো ব্যাখ্যা পেতে নতুন কোনো উপাত্ত পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। কুরআন যে আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে, সেটা এ ধরনের সংশয়হীনতার ওপর ভিত্তি করে নিশ্চিত করা যায়। কুরআনের অন্য কোনো রচয়িতা থাকার যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা নেই। আর যেসব উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে সেরা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, সেগুলোও সীমিত। যেমন, প্রাচীন আরবি ভাষায় আর নতুন কোনো বর্ণ তৈরি হবে না। বা একেবারে নতুন কোনো অগ্রহণীয় আরব ইতিহাস আর জন্ম নেবে না।
৫. যুক্তিপ্রমাণ গঠন
জ্ঞান আহরণে সাক্ষ্য এবং সেরা ব্যাখ্যার অনুমানের গুরুত্ব নিয়ে আলাপ করেছি এতক্ষণ। তবে কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতা সম্বন্ধে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী অভিজ্ঞ সাক্ষা থাকায় শুধু সমর্থনীয় সাক্ষা উদ্ধৃত করলেই যথেষ্ট হচ্ছে না। আমি সেজন্য সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্য উপস্থাপন করব। দেখাব, কেন কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতার সমর্থনমূলক সাক্ষ্যগুলো অগ্রাধিকার পাওয়ার উপযুক্ত।
কুরআনে ভাষিক ও সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়েছে। ৭ম শতকের আরবেরা আরবি ভাষায় সাহিত্যের মানদণ্ডে শিখরে অবস্থান করছিল। অথচ তারপরও তারা ব্যর্থ হয়েছে কুরআনের অনুকরণে কিছু রচনা করতে। এ বিষয়গুলো যদি প্রমাণিত হয়, তা হলে কুরআন অনুকরণ-অসাধ্য হওয়ার পক্ষে যেসব সাক্ষ্য আছে, সেগুলো মেনে নেওয়াটা হবে যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত। কুরআনের অনন্যতার সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোর সাথে বিরোধী সাক্ষ্যগুলো অযৌক্তিকতার পর্যায়ে পড়ে (কিছুক্ষণ পরেই ব্যাখ্যা করা হবে এটা)। সাক্ষ্যভিত্তিক তথ্য গ্রহণ করা হচ্ছে যেহেতু, কুরআন অনুকরণ-অসাধ্য হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাখ্যাগুলো তাই যাচাই করতে হবে সেরা ব্যাখ্যার অনুমান করার জন্য। কুরআন হয় কোনো আরবের রচনা, নয় কোনো অনারবের, নয়তো মুহাম্মাদ এর প্রণেতা, আর নয়তো সুমহান আল্লাহ। যুক্তিপ্রমাণটির সার বিষয়গুলো হচ্ছে:
- ★ মানবজাতির সামনে কুরআন ভাষিক ও সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ দেয়।
- ★ কুরআনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সবচে ভালো অবস্থানে ছিল ৭ম শতকের আরবেরা।
- ★ ৭ম শতকেরা আরবেরা চ্যালেঞ্জে হেরে গেছে।
- ★ কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্য হওয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সাক্ষ্য দিয়েছেন।
- ★ পাণ্ডিত্য-বিরোধী সাক্ষ্যগুলো সত্য হওয়া সম্ভব না। কারণ, তা হলে প্রতিষ্ঠিত তথ্যকে বাতিল করতে হবে।
- ★ সুতরাং (১-৫ থেকে), কুরআন অনুকরণ অসাধ্য।
- ★ কুরআন অনুকরণ অসাধ্য হওয়ার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এর রচয়িতা, কোনো আরব, অনারব, মুহাম্মাদ (সাঃ) কিংবা আল্লাহ।
- ★ এটা কোনো আরব, অনারব বা মুহাম্মাদের পক্ষে রচনা করা সম্ভব ছিল না।
- ★ কাজেই, আল্লাহই যে এর রচয়িতা, এটাই সেরা ব্যাখ্যা।
এ অধ্যায়ের বাকি অংশে উপরোক্ত হেতুবাক্যগুলো সবিস্তারে আলোচনা করা হবে।
৬. মানবজাতির সামনে কুরআনের ভাষিক ও সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ
“পাঠ করো তোমার প্রভুর নামে।" [18]
– ১৪ শ বছর আগে নবি মুহাম্মাদের কাছে অবতীর্ণ প্রথম কথা ছিল এগুলো। মাক্কা থেকে কিছু দূরে এক পর্বতগুহায় তখন নিবিড় চিন্তায় মগ্ন ছিলেন নবিজি (সাঃ)। সেদিন তাঁর কাছে এমন এক গ্রন্থ প্রকাশ পেল, গোটা দুনিয়াজুড়ে যার প্রভাব ছড়িয়ে আছে আজও।
কবিতা বা পক্তি রচনায় একেবারেই কোনো পরিচিতি ছিল না নবিজির। ভাষার বাঙ্ময় ব্যবহারেও বিশেষ কোনো প্রতিভা তাঁর মাঝে দেখেনি কেউ। মাত্রই তাঁর কাছে যে-গ্রন্থের প্রথম কিছু কথা অবতীর্ণ হলো, ধীরে ধীরে সেখানে আসবে বিশ্বাসের কথা, বিধি-প্রথা, আধ্যাত্মিকতা, অর্থনীতিসহ যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গের কথা। আর পুরোটাই হবে সম্পূর্ণ অভিনব এক ধরনে, অনুপম সাহিত্য রীতিতে। [19]
কুরআন যে-ঐশী গ্রন্থ, মুসলিমরা তাদের এই বিশ্বাসকে প্রমাণ করতে কুরআনের অনন্য সাহিত্যিক ও ভাষিক উপাদান ব্যবহার করে বেশ কিছু যুক্তিপ্রমাণ দাঁড় করিয়েছিলেন। এ নিয়ে ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রে কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতা বা ‘আল ইজাযুল কুরআন' নামে জ্ঞানের এক স্বতন্ত্র শাখার বিকাশ ঘটে। ক্রিয়াবিশেষ্য ‘ই’জায’ শব্দটির মানে ‘অলৌকিকতা'। ‘আ’জাযা’ শব্দটি থেকে এসেছে এই শব্দটি। এর মানে ‘কোনো কিছু করা অসম্ভব করা’ বা ‘অসহায় করা। পরিভাষাটির শাব্দিক অর্থ থেকে বোঝা যায়, কুরআনের অনুরূপ কিছু রচনা করাকে আরব ভাষাবিদেরা অসম্ভব মনে করতেন। ১৫ শতকের খ্যাতনামা লেখক ও জ্ঞানশাস্ত্রবিদ জালালুদ্দীন সুয়ুতি লিখেছেন।
“ নবি তাদের কাছে [চ্যালেঞ্জ] ছুড়ে দিলেন। ওরা ছিল তখন সবচে দক্ষ অলংকারপূর্ণ ভাষা ব্যবহারকারী। তো তিনি ওদের চ্যালেঞ্জ জানালেন [গোটা কুরআনের] অনুরূপ রচনা করতে। আল্লাহ তখন বললেন, 'ওরা যদি সত্যবাদী হয় তবে বলো অনুরূপ কিছু রচনা করতে।' বেশ কিছু বছর পেরিয়ে গেল। কিন্তু ওরা পারল না। এরপর [নবি] চ্যালেঞ্জ জানালেন এর মতো ১০টা সূরা রচনা করতে। আল্লাহ বললেন, “ওদের বলো, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়, তবে এর মতো ১০টা সূরা রচনা করো। আল্লাহ বাদে তোমাদের আর যত কাউকে পারো ডাকো।' এরপর তিনি চ্যালেঞ্জ জানালেন, কেবল একটা অনুরূপ সূরা রচনা করতে। আল্লাহ বলেছিলেন, 'তারা কি বলতে চায় তিনি [নবি] বানিয়েছে এটা? ওদের বলো, যদি সত্যবাদী হও তো অনুরূপ একটা সূরা রচনা করে দেখাও। আল্লাহ বাদে তোমাদের আর যত কাউকে পারো ডাকো, ওদের মাঝে ছিল সবচে দক্ষ অলংকারপূর্ণ ভাষা ব্যবহারকারীরা। অথচ তারপরও [কুরআনের] অনুরূপ একটি সূরাও রচনা করতে পারল না [আরবেরা]। [নবি] সবার সামনে ওদের চ্যালেঞ্জের জবাব দেওয়ার] ব্যর্থতা ও অক্ষমতা জানিয়ে দিলেন। ঘোষণা করলেন কুরঅানের অনুকরণ-অসাধাতা। আল্লাহ বলে দিলেন, ওদের বলো, সব মানুষ আর জিন দিলে একে অন্যকে সাহায্য করেও যদি কুরআনের অনুরূপ কিছু তৈরি করতে চায়, পারবে না…। [20]
কুরআনের কালজয়ী ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলো অনুসারে, কুরআনের যেসব আয়াতে এর অনুরূপ একটি সূরা রচনার চ্যালেঞ্জ জানানো আছে, পরোক্ষভাবে সেগুলো পরবর্তী যুগের সব ভাষাবিদদেরও আহ্বান করেছে।[21] এই চ্যালেঞ্জ পুরণের হাতিয়ার কেবল নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকরণগত বিধি, ভাষিক ও সাহিত্যিক কলা এবং আরবি ভাষার মাত্র ২৮টি বর্ণমালা। স্বাধীন ও বাস্তব এসব তুণগুলো সবার জন্যই লভ্য। অথচ তারপরও যে আজ পর্যন্ত কেউ এই চ্যালেঞ্জ পুরো করতে পারেনি তা কিন্তু আরবি ভাষা ও কুরআনের বিশেষজ্ঞদের মোটেই অবাক করে না।
৭. কুরআনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সবচে ভালো অবস্থানে ছিল সপ্তম শতকের আরবেরা
সেই সময়ের আরবেরা যে ভাষিক দক্ষতায় শিখরে অবস্থান করছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় পুব-পশ্চিমের বিভিন্ন বইপত্র থেকে। জ্ঞানশাস্ত্রবিদ তাকি উসমানির মতে, সপ্তম শতকের আরবদের কাছে
“বাকপটুতা এবং ভাষা অলংকার ছিল অক্সিজেনের মতো।”[22]
নবম শতকের কবিদের জীবনীকার জুমাহির মতে,
“আরবেরা যা কিছু জানত পড়ক্তির ছন্দে তা লিপিবদ্ধ করে রাখত। এটা ছিল তাদের জ্ঞানের সর্বোচ্চ সীমার পরিচায়ক। তারা যেন পক্তি বলতে বলতে ঘুম থেকে উঠত, আবার বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়ত।"[23]
আরবদের জীবনে কবিতার গুরুত্ব তুলে ধরে ১৪ শতকের ইতিহাসবিদ ইবনু খালদুন লিখেছেন,
“কথা বলার মাধ্যম হিসেবে কবিতাকে খুব উঁচু নজরে দেখত আরবেরা। তারা একে করে নিয়েছিল তাদের ইতিহাসের নথি, ভালো-খারাপের প্রামাণ্যগ্রন্থ, তাদের বেশির ভাগ পর্যবেক্ষণ আর জ্ঞানের উৎসের মূল আকরগ্রন্থ।" [24]
সপ্তম শতকের আরব সমাজে ভাষিক দক্ষতা ও সামর্থ্যের প্রভাব ছিল প্রচুর। সাহিত্য-সমালোচক ও ইতিহাসবিদ ইবনু রাশীক উদাহরণ দিয়ে বলেছেন,
“আরব গোত্রে যখনই কোনো কবির আবির্ভাব হতো, অন্যান্য গোত্র আসত অভিনন্দন জানাতে। খাবারদাবারের আয়োজন করা হতো। বিয়েতে যেভাবে নারীরা বীণাজাতীয় এক বাদ্য বাজাত, তখনও বাজাত। এই সুখবরে বয়স্ক-যুবা—সব ধরনের মানুষ আনন্দ করতেন। কোনো কবির আবির্ভাব হলে, বা সন্তান জন্ম নিলেই আরবেরা শুধু তখনই একে অন্যকে অভিনন্দন জানাত।"[25]
৯ম শতকের জ্ঞানশাস্ত্রবিদ ইবনু কুতাইবা আরবদের চোখে তুলে ধরেছেন কবিতার সংজ্ঞা:
“আরবদের জ্ঞানের খনি, তাদের জ্ঞানগ্রন্থ বিতর্কের দিনে প্রকৃত সাক্ষী, তর্কের সময় চূড়ান্ত প্রমাণ।" [26]
আরবি ভাষা পুরোপুরি করায়ত্ত করতে আরবদের কী পরিমাণ পড়াশোনা করতে হতো তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ লেখক নাভিদ কারমানি। তার কথা থেকে বোঝা যায় ৭ম শতকে আরবেরা বলতে গেলে কবিতা-পুজো করত:
“প্রাচীন আরবি কবিতা খুবই জটিল বিষয়। আরবি ভাষার শব্দভান্ডার, ব্যাকরণগত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আর কঠিন নিয়মগুলো সঞ্চারিত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কেবল সবচে সহজাত প্রতিভাধর ছাত্ররাই করায়ত্ত করতে পেরেছে এ-ভাষা। কোনো ছাত্রকে হয়তো কখনো কখনো নিবিড়ভাবে চর্চা করতে হয়েছে কোনো কবিগুরুর অধীনে দশকের পর দশক। কেবল তখনই সে নিজেকে পরিচয় দিতে পারত কবি বলে। যে-সমাজে বড় হয়েছেন মুহাম্মাদ, কাব্যিক ভাষাভঙ্গিকে তারা যেন প্রায় পূজনীয় করে তুলেছিল।" [27]
মোট কথা, আরবি ভাষার অতুলনীয় ব্যবহারকে সহজসাধ্য করতে ঠিক যেরকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের দরকার ছিল, সপ্তম শতকে ওখানকার পরিবেশ ছিল তেমনই।
৮. ব্যর্থ হলো সপ্তম শতকের আরবেরা
এমন অতুলনীয় ভাষাদক্ষতা থাকার পরও সামষ্টিকভাবে তারা ব্যর্থ হয়েছে কুরআনের ভাষিক ও সাহিত্যিক মানের ধারেকাছে কিছু রচনা করতে। ভাষাবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হুসেইন আবদুর রাউফ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন,
“ভাষিক যোগ্যতা ও জ্ঞানে, অলংকারপূর্ণ ভাষা ব্যবহারে এবং কবিতায় সে সময়ে আরবেরা ছিল চূড়োয়। অথচ তারপরও কুরআনের অনুরূপ একটি সূরাও রচনা করতে পারেনি তারা।" [28]
কুরআন-শাস্ত্রের অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলিকা নিয়োরিথ যুক্তি দেখিয়েছেন, অতীতে বা বর্তমানে কেউ কখনো সফলতার সঙ্গে কুরআনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি:
“ কেউ সফল হয়নি। এটা সঠিক… আমার সত্যিই মনে হয়, কুরআন এমনকি পশ্চিমা গবেষকদেরও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। যে সময়ে সমাদৃত কোনো লিখিত পুস্তক। ছিল না, সেখানে কীভাবে হঠাৎ করে এত সমৃদ্ধ সব বিষয় আর চমৎকার কথামালায়। সাজানো কুরআনের আবির্ভাব ঘটল, তা স্পষ্ট করতে পারেন না তারা।" [29]
সাব'উ মু'আল্লাকাত বা সপ্তগাথা কবিতার বিখ্যাত কবি লাবিদ বিন রাবী'আ কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতার কারণেই বরণ করেছিলেন ইসলাম। কুরআনের বাক্বৈদগ্ধে এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন, এরপর আর কোনো কবিতা রচনা করেননি। লোকেরা বেশ অবাক হয়েছিল তার এমন পরিবর্তনে। “তিনি ছিলেন তাদের সবচে কৃতী কবি।”[30] তারা জিজ্ঞেস করলেন কেন তিনি কবিতা রচনা বন্ধ করে দিয়েছেন।
তিনি জবাব দিয়েছিলেন,
“কী বলো তোমরা কুরআন অবতীর্ণের পর কীভাবে তা করতে বলো?[31]
আরবি ভাষা ও কুরআন-বিষয়ক অধ্যাপক ই এইচ পালমার যুক্তি দেখিয়েছেন, বিশেষজ্ঞদের এমন কথায় আসলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তিনি লিখেছেন
“আরবের সেরা সেরা লেখকেরা যে কুরআনের সমমানের কিছু রচনা করতে পারেনি তাতে একেবারেই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।" [32]
৭ম শতকেরা আরবের কীভাবে এই চ্যালেঞ্জে মোহাবিষ্ট হয়ে নিজেদের অক্ষমতার পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছে, তার উল্লেখ করে অধ্যাপক এম. এ. দ্রাজের বক্তব্য:
“আরবি ভাষা ব্যবহারের দক্ষতায় যখন সোনালি সময়, ভাষা যখন আরোহণ করেছিল পবিত্রতা আর শক্তির চূড়োয়, যখন কিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বার্ষিক উৎসবে কবি-কথকদের সম্মাননা দেওয়া হতো, কুরআন এক ঝাটকায় মুছে দিয়েছিল কবিতা বা অলংকারপূর্ণ কথাবার্তার প্রতি তাবত উদ্দীপনা। কা'বার দরজায় ঝুলে থাকা সপ্ত সোনালি কবিতাকে পর্যন্ত বাধ্য করেছিল নামিয়ে ফেলতে। সবার কান যেন চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হয়েছিল কুরআনি আরবির বিস্ময়কর শক্তিতে। [33]
সপ্তম শতকের আরবেরা যে কুরআনের অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি, সে সম্বন্ধে এতবেশি সাক্ষ্য পাওয়া যায়, এ নিয়ে তাই আর কোনো সংশয়ের জায়গা থাকে না। আরবদের অক্ষমতার বিষয়টিকে বাতিল করে দেওয়াটা কোনো ধরনের যুক্তির বিচারে টিকবে না। এছাড়া এ বিষয়ে চাক্ষুস সাক্ষীও পৌঁছেছে ‘তাওয়াতুর’ পর্যায়ে। বিভিন্ন পরম্পরায় বেশুমার অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা একথা জানিয়েছেন। এবং এদের অনেকেরই কখনো দেখা হয়নি একে অপরের সঙ্গে।
সেসময়ের আরবদের ব্যর্থতার খতিয়ানে সবচে জোরালো যুক্তি তৎকালের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কুরআনের মূল আলোচনার অন্যতম অংশ জুড়ে আছে ৭ম শতকীয় মাক্কি গোত্রগুলোর অনৈতিকতা, অন্যায় ও অসদাচরণের নিন্দা। নারীদের পণ্য মনে করা, ব্যবসায় প্রতারণা, মূর্তিপূজা, দুর্বলদের অন্যায্যভাবে দাস বানিয়ে রাখা, সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা, কন্যা সন্তানদের হত্যা, এতিমদের সাথে অসদাচরণ—ইত্যাদি নানাবিধ অপকর্মে জর্জরিত ছিল তারা। কুরআনের নীতিনৈতিকতার বার্তা তাই ওইসময়ের নেতৃস্থানীয় লোকদের আসন টলিয়ে দিয়েছিল। তাদের অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও নেতৃত্ববাজির জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল কুরআন। ক্রমেই কাল হয়ে দাঁড়ানো ইসলামের এই অগ্রগতি থামাতে কুরআনের ভাষিক ও সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জটা পূরণ করলেই কিন্তু হয়ে যেত। কিন্তু মাক্কার সেই অবক্ষয়-জর্জরিত সময়টাতে যে ইসলাম সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে গেছে, তাতেই প্রমাণ হয় সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ব্যর্থতা। কোনো আন্দোলনের মৌলিক দাবিকে যদি স্পষ্টভাবে মিথ্যে প্রমাণ করা যায়, তবে সেই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মাক্কার নেতাগোছের লোকেরা কুরআনের চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে পারেননি। আর তাই তারা নির্যাতন-নিপীড়নের আশ্রয় নিয়ে দমাতে চেয়েছিলেন ইসলামের অগ্রযাত্রা।
৯. কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য
পুব-পশ্চিমের ধর্মী-নিধর্মী বেশুমার বিশেষজ্ঞ সাক্ষ্য দিয়েছেন কুরআনের অনুকরণ অসাধ্যতা সম্বন্ধে। সেগুলো থেকে অল্প কিছু নমুনা তুলে দিচ্ছি প্রাচ্যবিশারদ অধ্যাপক মার্টিন জ্যামিট:
“ইসলাম-পূর্ব সময়ে অসাধারণ সাহিত্যমান-সম্পন্ন বেশ কিছু দীর্ঘ কবিতা আছে যদিও আরবি ভাষায় সর্বোচ্চ মানের লিখিত রূপের মাঝে কুরআনের তুলনা কুরআনই।”[34]
মনীষী শাহ ওয়ালিউল্লাহ
“ভাষা অলংকারের সর্বোচ্চ নমুনা এটা। কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব না এমন কিছু রচনা। তবে আমরা যেহেতু কুরআন অবতরণকালীন] প্রাথমিক আরবদের পরে এসেছি, আমরা তাই এর রস পুরোপুরি আস্বাদন করতে অক্ষম। কিন্তু কোনো ধরনের কৃত্রিমতা ছাড়া যে-সহজবোধ্য শব্দ আর শ্রুতিমধুর গঠন আমরা পাই এখানে, তা আগে-পরের কোনো কবিতার মাঝে পাওয়া যায় না।" [35]
প্রাচ্যবিদ ও সাহিত্যিক এ.জে. অ্যারবেরি:
“প্রথমত চেয়েছি আমার আগে যারা অনুবাদ করেছেন, তাদের থেকে উন্নত করতে। দ্বিতীয়ত চেয়েছি আরবি কুরআনের অতি উচ্চমানের সাহিত্য শৈলীকে—সামান্যতম পরিমাণে হলেও উপস্থাপন করতে। তা করতে গিয়ে আমাকে ঘাম ঝরাতে হয়েছে কুরআনের ভাষাশৈলীর খুবই জটিল ও বৈচিত্র্যময় নানা ছন্দ ও মাত্রা বুঝতে। কুরআনের অনুপম বার্তা তো আছেই, এই জটিল বিচিত্র সাহিত্যশৈলী গুণেই কুরআন নিজেকে দাবি করে সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবে।”[36]
প্রখ্যাত ইসলাম বিশারদ তাকি উসমানি
“তাদের কেউ কুরআনের আয়াতের অনুরূপ সামান্য একটা পঙ্ক্তিও রচনা করতে পারেননি। ভাষাসাহিত্যে তারা কেমন নৈপুণ্য গুণসম্পন্ন লোক ছিলেন। তা শুধু ভেবে দেখুন একবার। ‘আল্লামা জুরজানি বলেছেন, পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তের কেউ যদি তার ভাষাবৈভব আর অলংকারপূর্ণ কথা নিয়ে গর্ব করত, আর এরা যদি কোনোভাবে জানতে পারত সেটা, কবিতার চরণে তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে কসুর করত না তারা। সেখানে কুরআনে এমন বারবার তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে আর তারা চেষ্টা করেননি, তা অসম্ভব নবিজির উপর নিপীড়ন চালাতে কোনো কিছু বাদ দেননি তারা। তাঁর ওপর নির্যাতন। চালিয়েছেন, তাঁকে পাগল, জাদুকর, কবি, গণক বলেছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও কিন্তু তারা পারেননি কুরআনের আয়াতের অনুরূপ দু-একটা পঙ্ক্তি রচনা করতে।" [37]
মনীষী ফখরুদ্দীন রাজি
"কুরআনের ভাষা-অলংকারের শক্তি এবং এর অনন্য শৈলীর কারণে এর নকল করা অসম্ভব। সামান্যতমও ত্রুটি নেই এতে। [38]
মনীষী যামলাকানি
“এর শব্দগুলো তাদের মাত্রার সঙ্গে নিপুণ স্বরসংগতি বজায় রাখে। এর বিশিষ্ট অর্থবাচক শব্দগুচ্ছের অর্থগুলো শ্রেষ্ঠ মানের। প্রতিটি শব্দ আর পদগুচ্ছের সাহিত্য-ধরন অনুপম। [39]
অধ্যাপক ব্রুস লরেন্সঃ
“বাস্তব নিদর্শন হিসেবে, কুরআনের আয়াতগুলো এক অফুরান সত্যের ভাব প্রকাশ করে। অর্থের বাতাবরণে অর্থ, আলোর ওপরে আলো, বিস্ময়ের পরেবিস্ময় ফুটিয়ে তোলে এগুলো।”[40]
অধ্যাপক এবং আরবি বিশারদ হ্যামিলটন গিব
“অন্যসব আরবদের মতো তারাও ছিলেন ভাষা ও অলংকার বিশেষজ্ঞ। কুরআন যদি তাঁর নিজের রচনা হতো, তা হলে অন্য কেউ ঠিকই টক্কর দিতে পারত। [আল্লাহ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছেন,] কুরআনের অনুরূপ দশটি আয়াত রচনা করুক তারা। যদি না পারে (তারা যে পারেনি তা তো দেখাই গেছে), তা হলে কুরআনকে তারা অসামান্য প্রামাণিক অলৌকিকতা হিসেবে মেনে নিক।” [41]
কুরআনের অনুকরণ অসাধ্যতা সম্বন্ধে যে-বেশুমার সাক্ষ্য আছে, তার থেকে সামান্য কিছু নমুনা ওপরে উল্লেখ করলাম।
৯.১ ‘অনুকরণ-অসাধ্যতা’র আরও কিছু নজির মুতানাব্বি ও শেক্সপিয়র
আবু তায়্যিব আহমাদ বিন হুসাইন মুতানাব্বি কিন্দিকে অননুকরণীয় এক কবি প্রতিভা বিবেচনা করেন অনেক আরব। কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়েছেন, অন্যান্য কবিরা তার মতো স্তুতিকাব্য এবং কাব্যিক মাত্রা ব্যবহার করেছেন বটে; কিন্তু তারা বাক্যালংকর এবং শৈলীগত ভিন্নতা ছুঁতে পারেননি। এ থেকে তারা সিদ্ধান্ত টানেন, মুতানাব্বির কবি-প্রতিভা অননুকরণীয়। কারণ, তার কাজের খুঁটিনাটি, ভাষিক কলকব্জা আমাদের নাগালে আছে। কিন্তু তার কবিতায় কাব্যময় যে প্রকাশ তা কেউ নকল করতে পারছেন। না। একথা সত্য হলে কুরআনের অননুকরণীয় যুক্তি মাটি হয়ে যায়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে মুতানাব্বির প্রতি কারও কারও এমন উচ্চ ধারণা ভিত্তিহীন। ইহুদি কবি মুসা বিন আযরা এবং সুলাইমান বিন জিব্রীল মুতানাব্বির অনুকরণে কবিতা রচনা করেছেন। আরও মজার ব্যাপার হলো, আন্দালুসীয় কবি বিন হানি আন্দালুসি পশ্চিমের মুনাব্বি নামে পরিচিত। [42]
মধ্যযুগের আরবি কবিতা কিন্তু নতুন কোনো সাহিত্যের ধরন সৃষ্টি করেনি। কারণ, আগের কাব্যধারার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল এগুলো। সরাসরি অভিজ্ঞতার চেয়ে অতীতের সাহিত্যের ওপরই মধ্যযুগীয় কবিতাগুলো বেশি নির্ভর করত বলে মন্তব্য করেছেন পণ্ডিতপ্রবর ব্যক্তি ডেনিস ই, ম্যাক-অলি। [43]
প্রাচীন আরবি কবিতায় একজন কবি তার পূর্বসূরি কবির অনুরূপ ছন্দ, মাত্রা ও বিষয়বস্তুতে নতুন কবিতা রচনা করতেন। এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না তখন।[44] ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক এমিল হোমেরিন ইবনুল-ফারিদের সাহিত্যশৈলী বিশ্লেষণ করে বলেছেন,
“মুতানাব্বির কাব্যশৈলীর সৃজনশীল উপস্থাপন"।[45]
আবু নুওয়াসের কাব্যশৈলী থেকে ধার করেছেন বলে মুতানাব্বি নিজেই স্বীকার করেছেন।[46]
সাহিব বিন 'আব্বাদ এবং আবু আলি মুহাম্মাদ বিন হাসান হাতিমির মতো মধ্যযুগের আরব সমালোচকেরা মুতানাব্বির কাজ পর্যালোচনা করেছেন। বিন আব্বাদ লিখেছেন আল-কাশফ 'আন মাসাউই' শি'রুল-মুতানাব্বি। মুতানাব্বির সাথে সাক্ষাৎ থেকে জীবনীমূলক বর্ণনা দিয়ে হাতিমি লিখেছেন আর-রিসালাতুল-মুদিহা ফি যিকরি সারিকাতি আবিত-তায়্যিব আল-মুতানাব্বি। [47] এসব সাহিত্য সমালোচনা গ্রন্থে পাওয়া যায়, মুতানাব্বির কবিতাগুলো অসামান্য প্রতিভার পরিচয় মেলে ধরলেও, এগুলো অনুকরণ করা সম্ভব। হাতিমি বেশ শক্ত বিতর্ক উপস্থাপন করেছেন মুতানাব্বির কাজের সমালোচনায়। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, তার কবিতার অনন্য কোনো শৈলী নেই। অনেক ভুলও আছে। মুতানাব্বির ওপর করা হাতিমির সমালোচনাটি নিবিড় পাঠের পর অধ্যাপক সিগার এ বোনব্যাকার বলেছেন, হাতিমের “বিচার-বিশ্লেষণ বেশির ভাগ সময়ই সুযুক্তিপূর্ণ। তার সমালোচনা পড়ে মনে হয় যেন মুতানাব্বি ছিলেন গড়পরতা কবি। তার মাঝে মৌলিকতার অভাব তো ছিলই, ব্যাকরণ, শব্দভান্ডার, অলংকারেরও যথেষ্ট দখল ছিল না। কখনো কখনো খুবই নিচু রসের প্রমাণও পাওয়া যায়।" [48]
ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে শেক্সপিয়রের অতুলনীয়তার ব্যাপারে সাধারণ একটা ঐকমত্য আছে। তবে তার কাজগুলোকে কিন্তু অনুকরণ-অসাধ্য ভাবা হয় না। তার সনেটগুলো রচিত হয়েছে মূলত আয়াম্বিক পঞ্চস্বরাঘাতযুক্ত ছন্দ ব্যবহার করে। এই ছন্দে সনেটের প্রতিটি লাইনে দশটি করে সিলেবল থাকে। সিলেবলগুলো ৫ জোড়ায় বিভক্ত। এগুলো একেকটা আয়াম্ব বা আয়াম্বিক পর্ব নামে পরিচিত।[49] তার কাজের মূল ছক জানা, ব্রিটিশ নাট্যকার ক্রিস্টোফার মারলোর কাজের মাঝেও অনুরূপ শৈলী খুঁজে পাওয়া তাই আশ্চর্য ঠেকে না। অন্যদিকে শেক্সপিয়রের সমকালীন ক্র্যান্সিস বর্ম, জন ফ্লেচারসহ আরও অনেকের সঙ্গেই তুলনা করা হয় তাকে। [50]
৯.২ কুরআন অনুকরণ অসাধ্য হওয়া মানেই এটা ঐশী নয়
কোনো কোনো পণ্ডিতপ্রবর ব্যক্তি কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতা মেনে নিয়েছেন বটে; তবে একে ঐশীগ্রন্থ মানতে রাজি হননি। তো, এদের উদ্ধৃতি দিয়ে কুরআনকে ঐশীগ্রন্থের কাতার থেকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। যাহোক, আমি কিন্তু এখনো কুরআনের ঐশী হওয়া সম্বন্ধে কোনো যুক্তিপ্রমাণ দিইনি, দিয়েছি এর অনুকরণ অসাধ্যতা নিয়ে। ওপরের যুক্তি ব্যবহার করে যারা একে মানব রচিত প্রমাণ করতে চান, তারা আসলে অনুকরণ-অসাধ্যতার যুক্তিকে গুলিয়ে ফেলেন সেরা ব্যাখ্যার অনুমানের সঙ্গে।
আরেকটা বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি এখানে। এসব পণ্ডিতদের কাছে হয়তো সেরা ব্যাখ্যার অনুমান যুক্তিকে তুলে ধরা হয়নি। কিংবা কুরআনের অননুকরণীয়তার দার্শনিক প্রভাব সম্বন্ধে গভীরভাবে ভেবেচিন্তে দেখেননি তারা। হতে পারে তারা হয়তো দার্শনিক প্রকৃতিবাদের সমর্থক। যেকারণে কুরআনের পেছনে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা আছে বলে মানতে নারাজ তারা। প্রকৃতিবাদের প্রতি তাদের বিশ্বাস অতিপ্রাকৃত যেকোনো কিছুর অনুমান করা থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
আর তা ছাড়া আজকের এই আধুনিকতা-পরবর্তী সংস্কৃতিতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অনেক পণ্ডিতের পদচারণা সীমিত। যেকারণে তাদের অনেকেই কুরআনের ঐশীত্ব মেনে নিতে কিংবা ইসলাম বরণ করতে আগ্রহী নন। নিছক এক সাহিত্যকর্ম হিসেবেই কুরআন নিয়ে গবেষণা করেছেন তারা। আধুনিক জ্ঞানচর্চার জগতে এমনটা হরদম ঘটে। কাজেই, এধরনের পণ্ডিতেরা যখন কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতা নিয়ে ঘাটেন, তখন কেবল কুরআনের সাহিত্যমান নিয়েই তাদের মাথা ঘামানোর সম্ভাবনা বেশি; এর ঐশী দাবি নিয়ে নয়। তারা জানতে চান কুরআন কি অননুকরণীয় নাকি কৃত্রিম; হলে কতটা। কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্য হওয়ার বিষয়টি এর ঐশী উৎসের ব্যাপারে কী ইঙ্গিত দেয় সম্বন্ধে পুরোপুরি অনাগ্রহী তারা।
১০. বিরোধী সাক্ষ্যগুলো সম্ভব নয়, কারণ সেগুলো
প্রতিষ্ঠিত আবহ তথ্যকে বাতিল করে
উপরোক্ত আলোচনার আলোকে কুরআন অনুকরণ-অসাধ্যতার পক্ষে দেওয়া সাক্ষ্যগুলো গ্রহণ করাই সবচে যৌক্তিক—অল্প কয়েকজন বিদ্বানদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ আছে যদিও।
কুরআন অননুকরণীয়তার সমর্থনমূলক সাক্ষ্যগুলো অনেক বেশি যৌক্তিক। কারণ, মজবুত আবহ জ্ঞানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এটা। হেতুবাক্য ১, ২ ও ৩-এ এসব জ্ঞানের কথা বলেছি: মানবজাতির কাছে কুরআন এক ভাষিক ও সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ ছোড়ে। সপ্তম শতকের সবচে সিদ্ধহস্ত আরবেরাই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে।
বিরোধী সাক্ষ্যগুলো আমাদের অযৌক্তিক চিন্তাভাবনার দিকে নিয়ে যায়। কুরআনের চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে যারা কিনা সবচে সিদ্ধহস্ত ছিল, তারা কেন ব্যর্থ হলো, তার একটা উচিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখা দেয় তখন। এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে: প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে নাকচ করা। কিংবা সপ্তম শতকের ভাষা মুনশিদের চেয়ে প্রাচীন আরবি সাহিত্য সম্বন্ধে নিজের অনেক বেশি জ্ঞানবুঝ ও সমঝদারি আছে বলে দাবি করা। এ ধরনের ব্যাখ্যাগুলো বিরোধী সাক্ষ্যগুলোকে কোনো যৌক্তিক ভিত ছাড়া স্রেফ হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে বাতিল করে দিলে আরবি সাহিত্যের ইতিহাসকে নতুন করে রচনার প্রয়োজন পড়বে। আর সপ্তম শতকের ভাষা পণ্ডিতদের চেয়ে বর্তমান সময়ের কেউ প্রাচীন আরবি সাহিত্যের বেশি সমঝদার—সেটাও অমূলক। ওই সময়ের মানুষ এখনকার চেয়ে অনেক বেশি সমজাতীয় ভাষা পরিবেশে থেকেছেন। এরকম পরিবেশে নিজের ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা হতো বেশি। অন্য ভাষা থেকে ধার করা কিংবা ভাষার অবক্ষয়ের আশঙ্কা থাকত কম। বর্তমান সময়ের আরবি সাহিত্য প্রচুর। পরিমাণে বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ এবং অবক্ষয়ের শিকার। কাজেই ভাষিক বিশুদ্ধতা অর্জনের উর্বর সময় থেকে উঠে আসা মানুষদের চেয়ে নিজেকে উৎকৃষ্ট দাবি করা অযৌক্তিক।
এ ধরনের আপত্তিগুলোর দুর্বলতা তো আছেই। কুরআন অনুকরণ-অসাধ্যতা বিরোধী মতগুলো বিশ্লেষণ করলেও বিষয়বস্তুর জোলোভাব প্রকট হয়। এরকম একটা ঘাটতির উদাহরণ পাওয়া যায় নন্দিত জার্মান প্রাচ্যবিদ থিয়োডো নলডেকার কাজে। কুরআনের ভাষিক ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যের সমালোচনা করে এর অনুকরণ-অসাধ্যতাকে অস্বীকার করেছেন তিনি। তবে তার এমন সমালোচনা আসলে এ ধরনের দাবির ভিত্তিহীনতাই নতুন করে চোখে দেখিয়ে দয়ে। যেমন, নলডেকা মন্তব্য করেছেন, “থেকে থেকেই কুরআনে অস্বাভাবিক এবং বিকৃতভাবে ব্যাকরণগত পক্ষের বদল হয়।"[51]
তিনি আসলে কুরআনের যে-ভাষিক বৈশিষ্ট্যের সমালোচনা করছেন এর পারিভাষিক নাম ইলতিফাত বা ব্যাকরণিক বদল। খুবই কার্যকরী এক ভাষা অলংকার এটা। যেকোনো আরবি-পাঠের সাহিত্য-ভাবকে সমৃদ্ধ করে ইলতিফাত। এটা প্রাচীন আরবি ভাষা-অলংকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।[52] ভাষা-অলংকার নিয়ে আসির, সুন্নতি ও যারকাশির বইতে এসব বিষয় খুঁজে পাবেন আগ্রহীরা। [53]
তো, ব্যাকরণিক এই পরিবর্তনের মাঝে থাকে পক্ষ (শ্রোতা-পক্ষ, বক্তা-পক্ষ অন্য-পক্ষ), বচনের পরিবর্তন, যাকে উদ্দেশ্য করে বলা তার পরিবর্তন, কালের পরিবর্তন, বিভক্তি চিহ্নের পরিবর্তন, সর্বনামের জায়গায় বিশেষ্যের ব্যবহারসহ আরও অন্যান্য। এসব পরিবর্তনের মূল কাজ কথার কোথায় জোর দেওয়া হবে সেটার পরিবর্তন, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠককে সচেতন করা, পাঠের শৈলী সমৃদ্ধ করা।[54] ‘ইলতিফাত’ ছন্দ ও গতির মাঝে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা আনে। নাটকীয়ভাবে ধরে রাখে শ্রোতার মনোযোগ।
ব্যাকরণিক পরিবর্তনের এক চমৎকার উদাহরণ কুরআনের ১০৮তম সূরাটিঃ
“তোমাকে তো অবশ্যই আমরা কাওসার দিয়েছি। কাজেই তোমার প্রভুর প্রতি সালাত আদায় করো, কুরবানি করো। যে তোমায় ঘৃণা করবে, সে-ই তো নির্বংশ।"[55]
এই সূরার শুরুতে ছিল বক্তা-পক্ষ বহুবচন “আমরা”। সেটা বদলে গেল শ্রোতা-পক্ষে ..তোমার প্রভু”। এটা কিন্তু কোনো আকস্মিক পরিবর্তন নয়। বরং হিসেব করেই দেওয়া। আল্লাহ ও তাঁর নবির মাঝে এক অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। “আমরা” ব্যবহার করা হয়েছে আল্লাহর মহিমা, ক্ষমতা ও সামর্থ্যের বিষয়ে জোর দিতে। নবি মুহাম্মাদকে “ প্রাচুর্য” দেওয়ায় আল্লাহর ক্ষমতা ও সামর্থ্যের দিকে নজর কাড়ে ব্যক্তিবাচক সর্বনামটি। অন্যদিকে “তোমার প্রভু” কথাটি ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে সম্পর্কের গভীরতা, ভালোবাসা। আরবি ‘রাব্ব' শব্দটির—বাংলায় অর্থ করেছি 'প্রভু'—অনেকগুলো অর্থ আছে। শব্দটি দিয়ে কারও মনিব, পালনকারী, দেখভালকারীসহ আরও অনেক অর্থ বোঝায়। তো একারণে শব্দটির ব্যবহার হয়েছে যুতসই। কারণ, এখানে কথা বলা সালাত, কুরবানি আর উপাসনা নিয়ে “কাজেই তোমার প্রভুর প্রতি সালাত আদায় করো, কুরবানি করো।” তা ছাড়া এই সরাটি অবতীর্ণ করা হয়েছিল নবির মনকে প্রশান্ত করতে। এ ধরনের অন্তরঙ্গ ভাষার ব্যবহার মনোভাষিক প্রভাবও বাড়ায়।
কুরআন সম্বন্ধে থিয়োডর নলডেকারের সমালোচনা তার একান্তই ব্যক্তিগত বিচার। তবে প্রাচীন আরবি সম্বন্ধে তার অপরিপক্ক জ্ঞানও ফাঁস করে এটা। সপ্তম শতকের আরবেরা আরবিতে যে-মুনশিয়ানা অর্জন করেছিলেন, সে ব্যাপারে তার অক্ষমতাও নিশ্চিত করে। ব্যাকরণিক এসব পরিবর্তন কুরআনের গতিশীলতায় প্রাণ সঞ্চার করে।
ইলিতিফাত আরবি কাব্যসাহিত্যের এক অপরিহার্য শৈলী। কুরআন অবতীর্ণের সময় ভাষার এমন ব্যবহার ছিল সর্বজন পরিচিত। এই বৈশিষ্ট্যকে কুরআন এমনভাবে ব্যবহার করেছে, একদিকে এটা যেমন পাঠের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মানানসই হয়েছে, অন্যদিকে প্রচারিত বার্তার প্রভাবও বাড়িয়ে তুলেছে বহু গুণে। নিল রবিনসন ডিসকভারিং দ্যা কুর’আন: আ কন্টেম্পরারি অ্যাপ্রোচ টু আ ভেল্ড টেক্সট বইতে ব্যাকরণিক এই পরিবর্তনকে যথার্থই বলেছেন:
“…খুবই কার্যকর অলংকারসমৃদ্ধ উপাদান। "[56]
তো, মোট কথা, কুরআনের অনুকরণ-অসাধ্যতার বিপরীতে যেসব সাক্ষ্য আছে, সেগুলো যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, সমস্যা সমাধানের চেয়ে এগুলো বরং আরও সমস্যা তৈরি করে বেশি। এসব বিরোধী সাক্ষ্যগুলোর পক্ষে ভিত্তি জোগানো গবেষণাগুলো একে তো অপ্রতুল, আরবি ভাষা সম্বন্ধেও বুঝের অপরিপক্কতা দেখা যায় এসব গবেষণায়। কুরআন অনুকরণ-অসাধ্য—এই ধারণা বাতিল করতে নিচের প্রশ্নটার উত্তর জরুরি: কুরআনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারত যে আরবেরা, কেন তারা ব্যর্থ হলো? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরগুলো উদ্ভট। আর তাই বিরোধী সাক্ষ্যগুলো গ্রহণ করা নিঃসন্দেহে ভুল।
১১. সুতরাং (১-৫ থেকে) কুরআন অননুকরণীয়
১-৫ সংখ্যক হেতু থেকে বোঝা যায় কুরআন অনুকরণের অসাধ্যতার সত্যতা প্রমাণিত।
১২. কুরআনের অননুকরণীয়তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা—কোনো
আরব, অনারব, মুহাম্মাদ বা আল্লাহ এর প্রণেতা আরবি ভাষা যারা বোঝেন না, তাদের কাছে কুরআনের ঐশীত্ব স্পষ্ট করতে প্রয়োজন সাক্ষ্য এবং অনুমানের ব্যবহার। আমি এতক্ষণ আলোচনা করেছি, কুরআন যে অনুকরণ অসাধ্য তা নিয়ে বৈধ সাক্ষ্য আছে। এর অনুকরণ-অসাধ্যতার সেরা ব্যাখ্যা হয় কোনো আরব, অথবা অনারব, অথবা মুহাম্মাদ নয়তো আল্লাহ এর প্রণেতা।
কেউ কেউ যুক্তি দেখাতে পারেন অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও তো থাকতে পারে। কিন্তু আমরা ঠিক জানি না ওগুলো কী। এ ধরনের দাবিকে কেউ কেউ “ভৌতিক ভ্রান্ত ধারণা” নাম দিয়েছেন। যদি সত্যিই কোনো বিকল্প ব্যাখ্যা থাকে, তা হলে সেগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার টেবিলে তুলতে হবে। তা না হলে গাছের পাতা অভিকর্ষজ তরণের কারণে পড়ে না; এর পেছনে অন্য একটা ব্যাখ্যা হয়তো আছে, কিন্তু আমরা তা জানি না—বিষয়টা এরকম হয়ে যাবে।
১২.১ কোনো আরব, অনারব বা মুহাম্মাদ এটা রচনা করতে পারেন না।
কুরআনের আসল রচয়িতা কে হতে পারেন, এ অধ্যায়ের বাকি অংশে সেগুলো ভেঙে ভেঙে দেখাব।
আরব?
বেশ কিছু কারণে কুরআন কোনো আরবের রচনা হতে পারে না। প্রথমত, ভাষা ও সাহিত্যে তাদের অসামান্য দখল থাকলেও, কুরআনের চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। শুধু তাই না, সেই সময়ের বাঘা বাঘা কবিরা এর অননুকরণীয়তার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তৎকালের অন্যতম আলংকারিক ওয়ালিদ বিন মুগিরার কণ্ঠে ঝরে পড়েছে আশ্চর্যের রেণুঃ
“কী বলব! আল্লাহর কসম, আমার মতো করে কবিতা তোমাদের কেউ জানে না। কাব্য রচনা আর অলংকারেও আমার সঙ্গে পেরে ওঠার কেউ নেই এমনকি জিনেরাও। কিন্তু তারপরও, আল্লাহর কসম করে বলছি: মুহাম্মাদের কথা [মানে কুরআন] আমার জানা কিছুর সঙ্গেই মেলে না। আল্লাহর কসন, সে যা বলে তা শুনতে বড়ই মধুর—সৌন্দর্য আর মুগ্ধতা দিয়ে সাজানো।” [57]
দ্বিতীয়ত, সপ্তম শতকের আরবেরা নবিজিকে প্রথমে কবি বলে দোষারোপ করেছিল। মুসলিমদের সঙ্গে বিবাদ-লড়াইয়ের চেয়ে এটা অনেক সহজ ছিল তাদের জন্য। কিন্তু কথা হচ্ছে, আরবি ভাষায় দখল আনতে কাউকে বছরের পর বছর কোনো গুরু কবির অধীনে চর্চা করতে হতো। ওই সময়ের কেউ কিন্তু দাবি করেননি মুহাম্মাদ তাদের শিষ্য। তিনি যে তাঁর বার্তা প্রচারে সফল, এটাই তখনকার কবি-সাহিত্যিকদের কাছে মেলে ধরেছে কুরআনের অলৌকিকতা। কুরআন যদি অনুকরণ করাই যেত, তা হলে কোনো কবি অথবা সাহিত্যিক–এরচে ভালো না পারুক—অন্তত এর অনুরূপ কিছু রচনা করতেই পারতেন। তাদের ব্যর্থতার এ খতিয়ানকে স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ নাভিদ কেরমানি:
“কবিদের সঙ্গে এ লড়াইয়ে নিরঙ্কুশ সফলতা পেয়েছিলেন নবি। নয়তো ইসলাম এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত না।" [58]
আরও গোড়ার কথা, কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে নবিজির জীবদ্দশায়। যদি অন্য কোনো আরব এর রচয়িতা হতেন, তাকে তো তা হলে সব সময় নবিজির সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকতে হতো। যখনই প্রয়োজন পড়ত টুপ করে মুখে করে তৈরি থাকতে হতো তাকে। ঘটনা যদি সত্যিই এমন হতো ২৩ বছর ধরে সে কি পারত লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে?
ঠিক আছে, এই প্রজন্মের আরবেরা? বর্তমান আরবি সাহিত্যে ভালো দখল আছে, এমন কেউ কুরআনের অনুকরণ করতে পারবে—একথা ভিত্তিহীন। বেশ কিছু কারণ আছে এ বিষয়ের সমর্থনে।
প্রথমত, কুরআনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সবচে উপযুক্ত ছিলেন সপ্তম শতকের আরবেরা। যেখানে তারাই ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে বর্তমানে ভাষিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু আরবেরা তাদের পূর্বসূরিদের ছাপিয়ে যাবে এমন কথা অযৌক্তিক।
দ্বিতীয়ত, প্রাচীন আরবির চেয়ে বর্তমান আরবিতে আত্তীকৃত শব্দ যেমন ঢের বেশি, ভাষিক অবক্ষয়ও হয়েছে আগের চেয়ে অনেক। তো এমন এক ভাষা-পরিবেশে বেড়ে ওঠা কোনো আরব কীভাবে প্রাচীন আরবের বিশুদ্ধতম ভাষা-পণ্ডিতদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে?
তৃতীয়ত, কোনো সমসাময়িক আরব প্রাচীন আরবি শিখলেও, যেসব মানুষ নিমগ্ন ছিলেন ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করা এক সমাজে, তাদের মতো হতে পারবেন না কখনো।
অনারব?
কুরআন যেহেতু আরবি ভাষায়, কোনো অনারবের পক্ষে তাই এর রচনা অসম্ভব। সফলভাবে কুরআনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে আরবি ভাষায় দক্ষতা পূর্বশর্ত। কুরআনেও এদিকটার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে:
“আমি জানি অবিশ্বাসীরা বলে, 'একজন লোক তাকে এ কথাগুলো শিখিয়ে দিয়ে যায়।' অথচ ওরা যে-লোকটার কথা বলছে তার ভাষা তো অন্য। আর এই কুরআনের ভাষা পরিষ্কার আরবি।” [59]
কুরআনের কালজয়ী ব্যাখ্যাকার ইবনু কাসীর এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন:
“কুরআনের অনুপম ভাষাশৈলী, সুনিপুণ অর্থমালা—যা কিনা পূর্বের যেকোনো নবির কাছে পাঠানো গ্রন্থের চেয়ে অনেক বেশি নিপুণ–তা কীভাবে এমন কারও কাছ থেকে শেখা যায় যে কিনা আরবিই বলতে পারে না ঠিকমতো? সামান্য কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কেউ এমন কথা বলতে পারেন না।" [60]
কিন্তু কোনো অনারব যদি তখনই আরবি ভাষা শিখে থাকে। তা হলে ভাষায় কথা বলবেন। আর সেক্ষেত্রে আমি ওপরের প্রথম সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটা দেখতে বলব। কিন্তু তারপরও যে-জন্ম থেকে একটি ভাষায় বড় হয়, আর যাকে সেই ভাষা শিখতে হয়, দুজনের ভাষা ব্যবহারে পার্থক্য থাকে। প্রায়োগিক ভাষাবিদ্যা এবং অনুরূপ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা থেকে তার প্রমাণ মেলে।
একজন জন্মগত ইংরেজি ভাষী আর একজন দীক্ষিত ইংরেজি ভাষীর শব্দ ও বাগধারা ব্যবহারে পার্থক্য দেখা যায়।[61] কোনো ইংরেজি ভাষীর বাবা-মা জন্মগত ইংরেজি ভাষী কিনা, তা থেকেও তার মাঝে ভাষা ব্যবহারে পার্থক্য লক্ষ করা যায়।
যার বাবা-মা'র যেকোনো একজন বহিরাগত, কোনো কোনো কাজে তার ভাষিক দক্ষতায় ঘাটতি ধরা পড়ে।[62] ভাষা দক্ষতায় স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মাঝে পার্থক্য খালি চোখে দেখা না গেলেও গবেষণায় সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরা পড়েছে। কেনেথ হিল্টেন্সটাম এবং নিকলাস অ্যাব্রাহামসন একটি গবেষণা চালিয়েছিলেন এ বিষয়ে। তাদের গবেষণার নাম ছিল: হু ক্যান বিকাম নেটিভ-লাইক ইন আ সেকন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ? অল, সাম অর নান? এ গবেষণায় দেখা গেছে, যোগ্য অস্থানীয় ভাষীদের ত্রুটিগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং প্রণালিবদ্ধ ভাষিক বিশ্লেষণ ছাড়া বোঝা যায় না।[63] কাজেই, অননুকরণীয় এবং অনুপম সাহিত্যকর্ম কুরআনের রচয়িতা কোনো আরব বা অনারব হওয়া বাস্তবসম্মত না।
তবে কি নবি মুহাম্মাদ ?
আরবের তৎকালের ভাষা-পণ্ডিতেরা শুরুতে নবিকে কবি আখ্যা দিয়ে দোষারোপ করেছিলেন। কিন্তু পরে আর এ নিয়ে রা করেননি। অধ্যাপক মোহর আলি লিখেছেন:
কোনো জ্ঞানবান ব্যক্তি কিন্তু কুরআনকে কবিতার বই মনে করেন না। নবি কখনো কবিতা রচনায় জড়াননি নিজেকে। ওয়াহির বিরোধিতাকারী অবিশ্বাসী কুরাইশরা শুরুতে তাঁর বিরুদ্ধে কবি হওয়ার দোষারোপ করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই তারা বুঝল তাদের অপবাদ সঠিক না। তারা তখন তাদের সমালোচনার ধারা বদলে ফেলে। নবি যেহেতু অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন, কাব্য-রচনায় অনভ্যস্ত, তারা বলল নিশ্চয়ই অন্য কেউ তাঁকে শিখিয়ে দেয়। তারা বলা শুরু করল, সেই লোক তাকে ‘পুরোনো কিচ্ছাকাহিনি' সকাল-সন্ধ্যায় বলে দেয় তাঁকে।”[64]
নবিজিকে কখনো ভাষা-পণ্ডিত বলে বিবেচনা করা হতো না। কবিতা রচনা বা ছন্দবদ্ধ পক্তি সাজাতেও তাঁকে দেখা যায়নি কখনো। কাজেই কেউ যদি বলেন, কোনো একভাবে বেমক্কা তিনি এক অনন্য সাহিত্যকর্ম রচনা করে ফেলেছেন, তা হলে সেটা রূপকথাকেও হার মানাবে। কেরমানি লিখেছেন,
“কবিতার জটিল কলাকৌশলগুলো তিনি শেখেননি, যখন প্রকাশ্যে আয়াতগুলো পাঠ করতেন... কিন্তু তারপরও তার পাঠ ছিল কবিতা, জ্যোতিষীদের ছন্দবদ্ধ গদ্য, কিংবা সেই সময়ের অন্যান্য মাত্রাবদ্ধ কথা থেকে অন্যরকম।"[65]
ইসলাম-বিশারদ তাকি উসমানি বলেছেন,
“এ ধরনের ঘোষণা কিন্তু সাধারণ কিছু না। এটা এমন একজন মানুষের কাছ থেকে এসেছে, যিনি কখনো তাঁর সমকালের কোনো কবি বা বিদ্বানের কাছ থেকে কিছু শেখেননি। তাদের কাব্য আসরে কখনো একটা চরণও আবৃত্তি করেননি। জ্যোতিষীদের মজলিশেও যাননি কখনো। নিজে থেকে কবিতা রচনা তো দূরের কথা, তিনি তো অন্যান্য কবিতার পঙ্ক্তিও মনে রাখতে পারতেন না।" [66]
এগুলো ছাড়াও কুরআনের আয়াতের শৈলী আর নবিজির হাদিসের ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এ দুয়ের পার্থক্যের দিকে ইঙ্গিত করে ড ড্রাজ যুক্তি দেখিয়েছেন।
“কুরআনের শৈলী পুরোটাই এক রকম। অন্যদিকে নবির কথাগুলো পুরোপুরি আলাদা। কুরআনের সঙ্গে এটা একেবারেই খাপ খায় না। কুরআন যেন উড়ন্ত পাখি। মানুষ তার নাগাল পায় না; পারে শুধু দৌড়ে সাথে থাকতে। মানুষের চেষ্টাগুলো যেন জমিনের বুকেই পড়েই থাকে। কেউ হয়তো হামাগুড়ি দেয়, কেউ-বা দ্রুত দৌড়ায়। কিন্তু কুরআনের সাথে যদি এদের সবচে দ্রুতগামীর তুলনা করেন, তা হলে মনে হবে অক্ষে ঘূর্ণিরত গ্রহ-নক্ষত্রের তুলনায় এরা যেন চলমান গাড়ির চেয়ে বেশি কিছু না।” [67]
শৈলীগত পার্থক্য সম্বন্ধে ড ড্যাজের যুক্তিটা যথেষ্ট শক্তিশালী নয় যদিও। কারণ, কবি এবং কথাশিল্পীরা তাদের দৈনন্দিন কথাবার্তা এবং কাজের ভাষার মাঝে শৈলীগত পার্থক্য বজায় রাখেন। নবিজি যে কুরআনের রচয়িতা নন, একথা প্রমাণে তাই এই যুক্তি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এখানে এটা উল্লেখ করার কারণ, যদি নবিজির কথার ধরন আর কুরআনের ভাষাশৈলী অনুরূপ বা কাছাকাছি হতো, তা হলে অননুকরণীয় ঐশীগ্রন্থ হিসেবে কুরআনের দাবি মাঠে মারা যেত।
নবিত্বের দায়িত্ব পালনে কত না ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করতে হয়েছে নবিজিকে। তার শিশু সন্তান মারা গেছে। প্রিয় স্ত্রী খাদিজা মারা গেছেন। সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখা হয়েছিল তাকে। তাঁর কাছের সঙ্গীদের নিপীড়ন করা হয়েছে, মেরে ফেলা হয়েছে। দুর্বিনীত বালকেরা পাথর ছুড়ে মেরেছে তাকে। মাদীনার জীবনে তিনি অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন সামরিক অভিযানে। সুদীর্ঘ এই সংগ্রাম-মুখর জীবনে কুরআন তার ঐশী স্বর আর রূপ হারায়নি একটি শব্দেও।[68] এসব বিক্ষুব্ধ সময় কিংবা নবি মুহাম্মাদের ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর ব্যাপারে নীরব থেকেছে কুরআন। নবি মুহাম্মাদ যদি কুরআন রচনাই করতেন, তবে যেসব মানসিক ও শারীরিক কষ্ট তিনি পার করেছেন, কুরআনে তার উল্লেখ না থাকা অসম্ভব।
সাহিত্যের মানদণ্ডে কুরআন এক অনুপম নিদর্শন। অথচ এর আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছে বিভিন্ন ঘটনা ও পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সময়ে সময়ে। প্রতিটি আয়াত প্রকাশিত হয়েছে কোনো সংশোধন-পরিমার্জন ছাড়াই। কিন্তু তারপরও কী আশ্চর্য। এভাবেই তৈরি হয়েছে সেরা এই সাহিত্যকর্ম। কাজেই কুরআনকে নবি মুহাম্মাদের সাহিত্যকর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করাটা ভিত্তিহীন। পৃথিবীর অসামান্য সব প্রতিভারা সেরা যেসব সাহিত্যকর্ম রচনা করেছে, বহু কাঁটাছেড়া, ঘষামাজার পর সেগুলো অর্জন করেছে সাহিত্যিক নিপুণতা। অন্যদিকে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে। আর একবার অবতীর্ণ হওয়ার পরও পরিবর্তন হয়নি একটি আ-কার, ই-কারেও। যেকোনো মানসম্পন্ন সাহিত্য গড়তে সম্পাদনা, সংযোজন-বিয়োজন অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্ব স্ব ব্যস্ততার মাঝে পরিশীলিত সাহিত্য রচনা করতে পারেন না কেউ। কিন্তু কুরআনের বেলায় তাই দেখি আমরা। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি ও সময়ে অবতীর্ণ হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আয়াত। আর একবার সে আয়াতগুলো উপস্থিত জনতার সামনে পাঠ করার পর নবিজি কিন্তু সেগুলোতে আর কোনো রদবদল করতে পারতেন না ওগুলোর ভাষা মান উন্নত করার জন্য। কুরআন যে নবিজির পক্ষে রচনা করা সম্ভব না, তার পক্ষে জোরালো পারিপার্শ্বিক প্রমাণ মেলে এখান থেকে। এটা সহ ওপরে আমি আরও যেসব প্রমাণ উল্লেখ করলাম, তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় নবিজির পক্ষে এমন সাহিত্যকর্ম রচনা খুবই খুবই অসম্ভব।
কয়েক পৃষ্ঠা আগে আমি কবি মুতানাব্বির কথা বলেছিলাম। আরবের অন্যতম কবি প্রতিভা বিবেচনা করা হয় তাকে। কেউ কেউ বলেছিলেন, তার কাজেরও তুলনা নেই কোনো। সে-ও মানুষ। তার মানে কুরআনও এমন কোনো মানুষেরই রচনা হবে। কিন্তু যুক্তির ধারা মানে না এমন তর্ক। কারণ, মুতানাব্বিকে তার রচনার নিপুণতা আনতে অনেকবার কাটাছেড়া করতে হয়েছে। [69] কিন্তু নবিজির বেলায় তা খাটে না। একবার কুরআনের একটা আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি একে কাটাছেড়া, ঘষামাজার করেননি। এ থেকে বলা যায় কোনো মানবীয় প্রতিভার শিল্পকর্ম নয় কুরআন।
তো, সব কথার শেষ কথা, কুরআন রচয়িতা হিসেবে নবিজির প্রতিভাকে টেনে আনার ভিত্তি নেই কোনো। অসামান্য কবিপ্রতিভাদেরও প্রয়োজন পড়ে তাদের কাজ সম্পাদনা, সংশোধন ও উন্নতির। কিন্তু কুরআনের বেলায় তা হয়নি। আমাদের হাতে যদি কোনো মানবীয় কর্মের নেপথ্য নকশা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকে, তা হলে তার অনুকরণ অসাধ্য নয়। শেক্সপিয়র ও মুতানাব্বির বেলায় তা দেখেছি আমরা। কুরআন যদি নবিজির কর্মই হতো, তা হলে তা অনুকরণ করা যেত।
শিল্পকর্ম সাহিত্য, এমনকি জটিল জটিল সব প্রযুক্তির নকশা এবং তা সম্পাদনের সরঞ্জাম হাতে থাকলে সেগুলোও নকল করা সম্ভব। কোনো কোনো শিল্পকর্ম খুবই অসাধারণ বা বিস্ময়করভাবে স্বতন্ত্র। কিন্তু তারপরও সেগুলো অনুকরণ করা যায়।[70] কিন্তু কুরআনের বেলায় এর নকশা (কুরআন নিজেই) এবং সরঞ্জাম (প্রাচীন আরবি ভাষার শব্দমালা এবং ব্যাকরণিক বিধি) হাতের নাগালে থাকার পরও এর ভাষা-অলংকার, সাহিত্য মান এবং ধরনের কিছু করা সম্ভব হয়নি আমাদের।
১৩. সেরা ব্যাখ্যা কুরআন আল্লাহর তরফ থেকে
কুরআন যেহেতু কোনো আরব, অনারব বা মুহাম্মাদের রচনা নয়, তা হলে সেরা ব্যাখ্যা হিসেবে এটাই দাঁড়ায় যে, এটা আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। কুরআনের অনুকরণ অসাধ্যতার পক্ষে এটাই সেরা ব্যাখ্যা। কারণ, উপস্থিত জ্ঞানের সাপেক্ষে বাকি সব ব্যাখ্যাগুলো অবাস্তব ঠেকে। এই উপসংহারের বিপরীতে সম্ভাব্য আপত্তি আসতে পারে, এই অনুমানটি কাজ করতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ধরে নেওয়া হয়। তখন তা হলে এক অতিপ্রাকৃতিক সত্তার অস্তিত্বের প্রশ্ন এসে যায়। কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তার অস্তিত্বে আগে থেকে বিশ্বাস না থাকলেও খাটবে আমাদের যুক্তিপ্রমাণটি। অন্য কোনো আস্তিকের কাছে এটার উপযোগিতা ফলবে বেশি। তবে তারপরও এটা বড় কোনো সমস্যা না। কারণ, আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে জোরালো প্রমাণ ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়ে গেছে।
আবার উল্টো দিক থেকেও সাজানো যায় যুক্তিটি। কুরআনের অনুকরণ অসাধ্যতাই আল্লাহর অস্তিত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটা যদি কোনো মানুষের রচনা না হয়, সম্ভাব্য সব ব্যাখ্যাই যদি অসাড় প্রমাণ হয়, তা হলে কে হতে পারেন এর রচয়িতা? কোনো মনুষ্য সাহিত্যিকের চেয়ে অনেক বেশি ভাষা-দক্ষতা আছে এমন কেউই হবেন। এর প্রণেতা। আর সেক্ষেত্রে অবধারিতভাবে আল্লাহর অস্তিত্বের বিষয়টা এসে যায়। সেকারণে আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে এক যৌক্তিক ভিত্তি দেয় কুরআনের অননুকরণীয়তা। কিংবা অতিপ্রাকৃতিক সত্তার ইঙ্গিত দেয় অন্তত।
বিজ্ঞানীরাও অনুরূপ যুক্তি খাটান তাদের গবেষণায়। হিগস-বসন আবিষ্কারের সাম্প্রতিক ঘটনাটাই খেয়াল করুন। হিগস ক্ষেত্রের মৌলিক উপাদান হিগস-বসন কণা। মহাজগতের আদি অবস্থায় কণাগুলোর মাঝে ভর পুরতে সচল হয়েছিল ক্ষেত্রটি। কণাটি আবিষ্কারের আগেও মহাজগতের আদি অবস্থায় ফোটন বাদে বাকি সব কণা ভরহীন অবস্থা থেকে ভরপ্রাপ্ত হওয়ার সেরা ব্যাখ্যা ছিল এটা। তার মানে পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হওয়ার আগেও লব্ধ উপাত্তের ভিত্তিতে হিগস-বসন কণা ছিল সেরা ব্যাখ্যা। এই একই যুক্তিধারা কুরআনের বেলায় খাটিয়ে বলা যায়, কুরআনের অনুকরণ অসাধ্যতার সেরা ব্যাখ্যা হলো মহান আল্লাহই এর রচয়িতা। আমাদের নাগালে থাকা তথ্য ও জ্ঞানের ভিত্তিতে বাকি সব ব্যাখ্যা যেহেতু মুখ থুবড়ে পড়ছে, কাজে এটাই সেরা ব্যাখ্যা।
১৪. বিকল্প অনুমান
কুরআনের অনুকরণ অসাধ্যতা সম্বন্ধে বিকল্প অনুমানগুলোর মধ্যে থাকতে পারে, কোনো উচ্চতর সত্তা এর প্রণেতা বা শয়তান। এ ধরনের অনুমানগুলোর বাস্তবতা অসম্ভব। সেজন্য এ অধ্যায়ের মূল আলোচনায় উল্লেখ করা হয়নি এগুলো। এদুটো নিয়ে এখন কথা বললেই বুঝবেন, কেন এগুলোর কথা বলিনি।
কুরআনের রচয়িতা হিসেবে কোনো উচ্চতর সত্তার কথা বলাটা স্রেফ শব্দের হেরফের ছাড়া আর কিছু না। “উচ্চতর সত্তা’ আসলে কী? আল্লাহ নিজেই কি উচ্চতর সত্তার সেরা ব্যাখ্যা নন? ‘উচ্চতর সত্তা’ মানে যদি হয় মানুষের চেয়ে বেশি ভাষিক ক্ষমতা, সামর্থ্যের অধিকারী কিছু, সেজন্য তা হলে আল্লাহ ছাড়া আর কে বেশি উপযুক্ত?
আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে এ বইতে এককভাবে প্রমাণ এসেছে। তো আমাদের সাথে তিনি যোগাযোগ করতে চাইবেন, সেটা খুবই সম্ভব। কারণ, তিনি তো কেবল স্রষ্টা বা পরিকল্পনাকারীই নন, যে-জগতে আমরা বাস করি, আমাদের টিকে থাকার জন্য উপযোগীও করেছেন একে। আমাদের দিয়েছেন একটা আত্মা বা সচেতন বোধ। পুরে দিয়েছেন নৈতিকতা। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব ও বিকাশে প্রবলভাবে নিয়োজিত তিনি। যেকারণে আকাশবাণীর মারফতে আমাদের সাথে তাঁর যোগাযোগ করার সম্ভাবনা অনেক। সুতরাং, নিজেকে আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে বলা দাবি করা কুরআনে যখন দেখি এমন সব বৈশিষ্ট্য আছে যা কেবল ঐশী কোনো কাজের মধ্যে পাওয়া সম্ভব, এর প্রণেতা হিসেবে আল্লাহকে মেনে নেওয়াই অর্থ বহন করে। কোনো অজ্ঞাত ‘উচ্চতর সত্তা’ অজ্ঞাত কারণে কুরআন রচনা করে থাকতে পারেন, এমন কথা বলা আর যেকোনো কিছুরই ব্যাখ্যায় কোনো অজ্ঞাত বস্তুর অস্তিত্বের ধরনা দেওয়া একই কথা।
কুরআন প্রণেতা হিসেবে শয়তানের কথাও ধোপে টেকে না। শয়তান কিংবা অন্য কোনো প্রাণসত্তা থেকে কুরআন আসা সম্ভব নয়। কারণ, ওধরনের কিছুর অস্তিত্বের ভিত্তি কুরআন অথবা আকাশবাণীই। মানুষ তো আর নিজে থেকে পর্যবেক্ষণ করে ওগুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়নি। যেকারণে কেউ যদি কুরআনের উৎস হিসেবে শয়তানের কথা বলেন, তাকে তা হলে শয়তানের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হবে। আর তা করতে গিয়ে প্রমাণ দিতে হবে আকাশবাণীর। শয়তানের অস্তিত্ব প্রমাণে কুরআনের বক্তব্য ব্যবহার করলে ঐশীগ্রন্থ হিসেবে কুরআনই প্রতিষ্ঠিত হবে আগে। কারণ, শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে হলে কুরআনকে ঐশী মানতে হবে প্রথমে কাজেই এই যুক্তি আত্মঘাতী। আকাশবাণী বলতে যদি বাইবেল (ইঞ্জিল) বোঝানো হয়, তা হলে শয়তানে বিশ্বাসের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে গ্রন্থটাকে আগে বৈধ ভিত্তি হিসেবে দেখতে হবে। বাইবেলের পাঠগত অবিকৃতি এবং ঐতিহাসিক প্রামাণিকতা-সংক্রান্ত সমসাময়িক গবেষণার আলোকে বাস্তবসম্মত নয়।[71] আর কুরআনের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করলেও বোঝা যায় এটা কোনো শয়তানের কারসাজি হতে পারে না। কারণ, এখানে উল্টো তাকেই নিন্দা করা হয়। আর যেধরনের নীতিনৈতিকতার সবক আমরা এখানে পাই, তা শয়তানি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মেলে না।
১৫. মোদ্দা কথা
সাক্ষ্য এবং সেরা ব্যাখ্যার অনুমান ব্যবহার করে কুরআনের ঐশী প্রকৃতির পক্ষে যুক্তিপ্রমাণ মেলে ধরেছে এ অধ্যায়। সাক্ষ্যের প্রামাণ্য ও মৌলিক ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবতা সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসতে ভাবনাচিন্তার যৌক্তিক ও বৈধ পদ্ধতি হিসেবে দেখানো হয়েছে সেরা সিদ্ধান্তের অনুমানকে। সাক্ষ্য ব্যবহার করে কুরআনের অনুকরণ অসাধ্যতা প্রমাণ করা যায়। আরবি ভাষাবিদ ও সাহিত্য-বিশারদেরা কুরআনের অননুকরণীয় গুণ নিশ্চিত করেছেন। প্রতিষ্ঠিত আবহ জ্ঞানের ভিত্তিতে তাদের সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব জ্ঞানের মধ্যে আছে কুরআন এক বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষিক ও সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জ ছোড়ে মানুষের কাছে। কুরআনের অনুপম বিষয়বস্তু এবং সাহিত্যিক ধরনের অনুকরণে কিছু রচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। প্রতিষ্ঠিত আবহ তথ্যের আলোকে কুরআনের অননুকরণীয়তার পক্ষে দেওয়া সাক্ষ্যগুলো গ্রহণ করা যেহেতু যুক্তিসম্মত, গ্রন্থটির অনুপম ভাষাশৈলী ও সাহিত্যমানের সেরা ব্যাখ্যায় তাই অনুমান করা হয়েছে। সম্ভাব্য ব্যাখ্যাগুলোর মাঝে আছে, কোনো আরব, অনারব, মুহাম্মাদ অথবা আল্লাহ এর রচয়িতা। কিন্তু লব্ধ তথ্যগুলোর আলোকে যেহেতু কোনো আরব, অনারব বা নবি মুহাম্মাদের পক্ষে এমন কিছু রচনা করা অসম্ভব, তাই সেরা ব্যাখ্যা হচ্ছে, মহান আল্লাহ এর প্রণেতা।
এ অধ্যায়ের উপসংহারকে অস্বীকার করা, আর পৃথিবীর গোলক আকার হওয়া। কিংবা প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের কথাকে অস্বীকার করা জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে একই কথা। পৃথিবী যে গোলক আকারের, তা আমাদের বেশির ভাগই জেনেছি সাক্ষ্যভিত্তিক জ্ঞানের মাধ্যমে। রোগ নির্ণয়ে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকদের সিদ্ধান্তগুলো সেরা ব্যাখ্যার অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। কেউ কেউ উপরোক্ত প্রমাণের বিরোধিতায় বলতে পারেন, আমরা অন্যান্য আরও যেসব জ্ঞান অর্জন করেছি তার ভিত্তিতে পৃথিবীর গোলক আকার হওয়া এবং চিকিৎসকের রোগ নির্ণয়ের সত্যতা প্রমাণিত হয়। এগুলো আমাদের অতিপ্রাকৃতের মতো অস্বাভাবিক কোনো দাবির দিকে নিয়ে যায় না। এই বিতর্কটা হরদম শোনা যায়। কিন্তু এটা প্রকৃতিবাদমূলক সত্তাতত্ত্বকে বিনা বিচারে সত্য বলে মেনে নেয়। অর্থাৎ একটা অনুমান লুকিয়ে থাকে এমন বিরোধিতার পেছনে। সেটা হচ্ছে অতিপ্রাকৃত যেকোনো কিছুকে অস্বীকার। এবং সবকিছুকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা যাবে বলে ধারণা। মনোদর্শন, ভাষা সামর্থ্য অর্জন ও বিকাশ, ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিক সত্য এবং মহাজগৎ সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে আধুনিক গবেষণার আলোকে এমন স্পর্ধিত ও ধৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি অযৌক্তিক এবং অসংগত। আর এ অধ্যায়ে আমি অতিপ্রাকৃত সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ দিইনি। আগের অধ্যায়গুলোতে তা আমি এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছি। এখানে শুধু বলেছি, যে-সত্তাকে আমরা আগের অধ্যায়গুলোতে প্রমাণ করেছি, নির্দিষ্ট কিছু সত্যের বেলায় তিনিই সেরা ব্যাখ্যা।
শেষ কথা, জগৎ সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনার সুযোগ নেই এমন সব বুদ্ধিবৃত্তিক বাধা সরিয়ে কেউ যদি মুক্ত মন নিয়ে এ অধ্যায়ের যুক্তিপ্রমাণগুলো দেখেন, বিশেষ করে আগের অধ্যায়ের তৈরি করা আবহের আলোকে, কুরআন যে ঐশী উৎস থেকে এসেছে—সবচে যৌক্তিক এই সিদ্ধান্তই নেবেন তারা। তবে সে যাই হোক, কুরআন সম্বন্ধে যত কিছুই বলা হোক বা লেখা হোক, এর শব্দ আর অর্থের প্রকাশে সব সময়ই কম পড়ে যাবে
“বলো, আমার প্রভুর কথা লিখতে যদি সব মহাসাগরের পানি কালি হয়, তবু সব কথা শেষ হওয়ার আগেই ফুরিয়ে যাবে কালি’–এমন কী অনুরূপ আরও মহাসাগরও যদি আমি যোগ করি, তবুও।” [72]
রেফারেন্সসমূহ(নাম্বারিং ঠিক করা হচ্ছে):
[৩১৭] আইইআরএ (২০১৩) লরেন্স ক্রস বনাম হামজা জর্জিস – ইসলাম বনাম এথিজম বিতর্ক। http://www.youtube.com/watch?v=uSwJuOPG4FI#t=7247 [Accessed 2nd October
[৩১৮] হিউম, ডি. (১৯০২) অ্যান এনকোয়ারি কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডাস্ট্যান্ডিং, সেকশান ৮৮।
http://www.gutenberg.org/files/9662/9662-h/9662-h.htm [Accessed 4th October 2016].
[৩১৯) ফ্রিকার, ই (২০০৬) টেস্টিমনি অ্যান্ড এপিস্টেমিক অটনমি। জেনিফার ল্যাকি, জে অ্যান্ড সোসা, ই, সম্পাদিত। দা এপিস্টেমোলোজি অভ টেস্টিমনি। অক্সফোর্ড: অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস, পৃষ্ঠা ২৪৪।
(৩২০) লেহরার, কে (২০০৬)। টেস্টিমনি অ্যান্ড ট্রাস্টওর্দিনেস। জেনিফার ল্যাকি, জে এবং সোসা,
ই, সম্পাদিত। দা এপিস্টেমোলজি অভ টেস্টিমনি। পৃষ্ঠা ১৪
(২১) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৯।
(২২) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫০।
(228) প্রাপ্ত।
(২৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫১।
(২৬) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৬।
(৩২৭) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৬ ১৫৭
Tes৮) ম্যাকমাইলার, বি. (২০১১) টেস্টিমনি, ট্রুথ অ্যান্ড অথরিটি, পৃষ্ঠা ৬৬।
(০২৯) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৯
(৬০) হিউম, ডি (১৯০২) অ্যান এনকোয়ারি কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডাস্ট্যান্ডিং, সেকশন ৯১। http://
www.gutenberg.org/files/9662/9662-h/9662-h.htm [Accessed 4th
October 2016]
(৩৩১) প্রাগুক্ত, সেকশন ৯৯।
(৬০২) লিপটন, পি. (২০০৪) ইনফারেন্স টু দা বেস্ট এক্সপ্ল্যানেশান। ২য় সংস্করণ। এবিংডন: রাউটলেজ,
পৃষ্ঠা ৫৬।
[eee) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৪-৬৫ (৪) হার্মান, জি. (১৯৬৫) দা ইনফারেন্স টু দা বেস্ট এক্সপ্ল্যানেশান। দা ফিলোসফিকাল রিভিউ,
৭৪ (১), ৮৮-৯৫। http://people.hss.caltech.edu/franz / Knowledge and Reality / PDF/
Gilbert
H. Harman - The Inference to the Best Explanation.pdf
[Accessed 4th October 2016]
(০০৫) কুরআন, ৯৬:১ (৩০৬) দা ম্যাগনিফিসেন্ট কুরআন: আ য়ুনিক হিস্টোরি অভ প্রিজারভেশান। (২০১০) লান্ডান
এক্সহিবিশান ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৪৫-২০৪ (ees) আল-সুয়ুতি জে. (২০০৫) আল-ইতকান ফি উলুমিল-কুরআন। মাদিনা: মুজাম্মা মালিক ফাহাদ,
পৃষ্ঠা ১৮৭৫
Tee৮) শাফি. এম. (২০০৫) মাআরিফুল-কুরআন, ২য় সংস্করণ। অনুবাদঃ মুহাম্মাদ জাসান আসকারি
এবং মুহাম্মাদ শামিম। কারাচি: মাকতাবায়ে দারুল উলুম। খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৩৯-১৪১ Teca) উসমানি, এম টি (২০০০) অ্যান অ্যাপ্রোচ টু দা কুরআনিক সায়েন্সেস। অনুবাদ মুহাম্মাদ সিদ্দিকি। পরিমার্জন ও সম্পাদনা রাফিক আবদুর-রাহমান। কারাচি: দারুল ইশাত,
সালিহ পৃষ্ঠা ২৬০।
(২৪) আরউইন, আর, (১৯৯৯) দা পেঙ্গুইন অ্যানথলজি অভ ক্ল্যাসিকাল অ্যারাবিক লিটারেচার। লাভান: পেঙ্গুইন বুকস, পৃষ্ঠা ২-তে উদ্ধৃত। ৪) ইবনু খালদুন, এ. দা মুকাদ্দিমাহ। অনুবাদ: ফ্রানজ রোজেনথাল। অধ্যায় ৬ ধারা ৫৮
www.muslimphilosophy.com/ik/Murqaddimah/Chapter6 / Ch6. 58.htm [Accessed 9th October 2016] (382) ইবনু রাশিক, এ. এইচ (২০০০) আল-উমদা ফি সিনাআতুশ-শিয়ার ওয়া নাকদিহি। সম্পাদনা ড. আন-নাবউই শালান। কায়রো: মাকতাবা খানিজি, পৃষ্ঠা ৮৯।
(৩৪৩) আল-কুতায়বা, এ. (১৯২৫) উবুনুল আখবার। বৈরুত: দারুল-কুতুবুল আরাবি। খণ্ড ২
পৃষ্ঠা ১৮৫।
(e88) কেরমানি, কে (২০০৬) পোয়েট্রি অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ। রিপিন, এ (সম্পাদিত) দা ব্ল্যাকওয়েল কম্প্যানিয়ন টু দা কুরআন। অক্সফোর্ডঃ ব্ল্যাকওয়েল পাবলিশিং, পৃষ্ঠা ১০৮।
[৩৪৫) আবদুর রউফ. এইচ. (২০০৩) এক্সপ্লোরিং দা কুরআন। ডান্ডি আল-মাখতুম ইন্সটিটিউট অ্যাকাডেমিক প্রেস, পৃষ্ঠা ৬৪
(৩৪৬) জার্মানিতে অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলিকা নিউরিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার। কেউ চাইলে ধারণকৃত অডিও দেওয়া যাবে।
(৪৭) ইসলাহি, এ. এ. (২০০৭) পন্ডারিং ওভার দা কুরআনছ তাফসির অভ সুরা ফাতিহা অ্যান্ড সুরা বাকারা। খণ্ড ১। অনুবাদং মোহাম্মাদ সালিম কায়ানি। কুয়ালা লামপুরছ ইসলামিক বুক ট্রাস্ট,
পৃষ্ঠা ২৫-২৬।
[৬৪৮) ইসলাহি, এ. এ. (২০০৭) পন্ডারিং ওভার দা কুরআনছ তাফসির অভ সুরা ফাতিহা অ্যান্ড সুরা
বাকারা খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৬-এ উদ্ধৃত। [৩৪১) প্যালমার, ই এইচ (অনুদিত) (১৯০০)। দা কুরআন। খণ্ড ১। অক্সফোর্ড ক্ল্যারেন্ডান প্রেস,
পৃষ্ঠা
(৩৫০) ড্যাজ, এম. এ. (২০০০)। ইন্ট্রোডাকশান টু কুরআন। লান্ডান: আই বি টরিস। পৃষ্ঠা ৯০। (৩৫১) জামিত, এম. আর (২০০২) আ কম্পারেটিভ লেক্সিকাল স্টাডি অভ কুরআনিক অ্যারাবিক।
লেডেন ব্রিল, পৃষ্ঠা ২৭ (৩৫২) ওয়ালিউল্লাহ, এস. (২০১৪) আল-ফাওজুল-কাবির ফি উসুলি-তাফসির। দা গ্রেট ভিক্টরি অন
কুরআনিক হার্মানিউটিক্স: আ ম্যানুয়াল অভ দা প্রিন্সিপলস অ্যান সাটেলিটিস অভ কুরআনিক
তাফসির। অনুবাদ, ভূমিকা ও টীকা: তাহির মাহমুদ কিয়ানি। লাভান। তাহা, পৃষ্ঠা ১৬০।
[৩৫৩) অ্যারবেরি, এ জে. (১৯৯৮) দা কুরআন: ট্র্যান্সলেটেড উইথ অ্যান ইন্ট্রোডাকশান বাই আর্থুর
জে অ্যারবেরি। অক্সফোর্ড: অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস, পৃষ্ঠা। [৩৫৪) উসমানি, এম. টি (২০০০) অ্যান অ্যাপ্রোচ টু দা কুরআনিক সায়েন্সেস, পৃষ্ঠা ২৬২। (৩৫৫) আস-সুয়ুতি, জে (২০০৫) আল-ইতকান ফি উলুমিল-কুরআন। মাদিনাঃ মুজাম্মা মালিক ফাহাদ,
পৃষ্ঠা ১৮৮১৷
(৩৫৭) লরেন্স, বি. (২০০৬)। দা কুরআন: আ বায়োগ্রাফি। লান্ডান আটলান্টিক বুকস, পৃষ্ঠা ৮ (৩৫৮) গিব, এইচ এ. আর. (১৯৮০) ইসলাম: আ হিস্টোরিকাল সার্ভে। অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস,
পৃষ্ঠা ২৮।
(৩৫৯) ফন জেড্ডার, জি. জে. এইচ. (২০১৩) ক্ল্যাসিকাল অ্যারাবিক লিটারেচার: আ লাইব্রেরি অভ অ্যারাবিক লিটারেচার অ্যানথলজি। নিউয়র্ক: নিউ য়র্ক য়ুনিভার্সিটি প্রেস, পৃষ্ঠা ৩১-৩৩া (৩৬০) ম্যাকঅলি, ডি. ই. (২০১২) ইবনু আরাবি'স মিস্টিকাল পোয়েটিকস। অক্সফোর্ড অক্সফোর্ড
য়ুনিভার্সিটি প্রেস, পৃষ্ঠা ১৩।
(৩৬১) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৪।
(৩৬২) ডি. ই (২০১২) ইবনু আরাবি'স মিস্টিকাল পোয়েটিকস। অক্সফোর্ড: অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি
প্রেস, পৃষ্ঠা ৯৪।
(৩৬) বোনব্যকার, এস. এ. (১৯৮৪), হাতিমি অ্যান্ড হিজ এনকাউন্টার উইথ মুতানাব্বি আ বায়োগ্রাফিকাল স্কেস। অক্সফোর্ড: নর্থ-হল্যান্ড পাবলিশিং কোম্পানি, পৃষ্ঠা ৪৭।
(ess) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫। দেখুন ওয়াং, ডব্লিউ (১৯৯৭) লিটারেরি ক্রিটিসিজম ইন মিডিয়াভিল অ্যারাবিক ইসলামিক কালচার দা মেকিং অভ আ ট্র্যাডিশান। এডিনবোরা য়ুনিভার্সিটি প্রেস) (৬৬৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্পা ৪৪
(৩৬৬) ম্যাবিলার্ড, এ (১৯৯৯) শেক্সপিরিয়ান সনেট বেসিকস: রামবিক পেন্টামিটার অ্যান্ড দা ইংলিশ
[Accessed 5th October 2016].
সনেট স্টাইল। http://www.shakespeare online.com/sonnets/sonnetstyle.html (৩৬৭) হল্যান্ড, পি. (২০১৩) শেক্সপিয়ার, উইলিয়ান (১৫৬৪-১৬১৬)। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অভ “ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি। অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস। http://dx.doi.org/10.1093/ref-codhab/25200
(Accessed 9th October 2016].
(e৯৮) আবদেল হালিম, এম. (২০০৫) আন্ডাস্ট্যান্ডিং দা কুরআনঃ থিমস অ্যান্ড স্টাইল। লান্ডান আই বি টরিস, পৃষ্ঠা ১৮৪-তে উদ্ধৃত। (esa) আবদুর রউফ, এইচ (২০০৩) এক্সপ্লোরিং দা কুরআন, ডান্ডি: আল-মাকতুম ইন্সটিটিউট অ্যাকাডেমিক প্রেস; আবদুর রউফ, এইচ (২০০১) কুরআন ট্র্যান্সলেশান ডিসকোর্স, টেক্সচার
অ্যান্ড এক্সেজিস। রিচমন্ড, সারে: কার্জন।
(650) আবদেল হালিম, এম.
(২০০৫) আন্ডাস্ট্যান্ডিং দা কুরআনঃ থিমস অ্যান্ড স্টাইসল, পৃষ্ঠা ১৮৫। (৩৭২) চৌধুরি, এস. জেড (২০১০) ইন্ট্রোডিউসিং অ্যারাবিক রেটোরিক। হালনাগাদ সংস্করণ। লান্ডান আদ-দুহা, পৃষ্ঠা ১৯।
(৩৭১) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৮।
(৩৭৪) কুরআন, ১০৮:১-৩
[৩৫] রবিনসন, এন. (২০০৩) ডিসকভারিং দা কুরআন: আ কন্টেম্পরারি অ্যাপ্রোচ টু আ ভেলড টেক্সট, ২য় সংস্করণ। ওয়াশিংটন জর্জটাউন য়ুনিভার্সিটি প্রেস, পৃষ্ঠা ২৫৪।
(৩৭৬) কাদি, ওয়াই (১৯৯৯)। অ্যান ইন্ট্রোডাকশান টু দা সায়েন্সেস অভ দা কুরআন। বার্মিংহাম আল হিদায়াহ, পৃষ্ঠা ২৬১-তে উদ্ধৃত। মূল অনুবাদে আল্লাহ শব্দের জায়গায় স্রষ্টা দেওয়া হয়েছে। (৩৭) কেরমানি, কে. (২০০৬) পোয়েট্রি অ্যান্ড ল্যাঙ্গোয়েজ। রিপিন, এ (সম্পাদিত) দা ব্ল্যাকওয়েল কম্প্যানিয়ন টু দা কুরআন। অক্সফোর্ড: ব্ল্যাকওয়েল পাবলিশিং, পৃষ্ঠা ১১০।
(৩৭৮) কুরআন, ১৬:১০৩
(৮৭১) ইবনু কাসির, আই (১৯৯১) তাফসিরুল কুরআনিল আজিম। খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬০৩। (২৮০। ভ্যানল্যাঙ্কার-সিদতিস, ডি (২০০৩) অডিটরি রিকগনিশন অভ ইডিয়মস বাই নেটিভ অ্যান নন-নেটিভ স্পিকার্স অভ ইংলিশ: ইট টেইকস ওয়ান টু নো ওয়ান। অ্যাপ্লাইড সাইকোলিঙ্গুইস্টিকস
28.82-291
(৩৮১) প্রাগুক্ত।
Ble hep
(৩৮২) হাইল্টেনস্টাম, কে অ্যান্ড অ্যাব্রাহামসন, এন. (২০০০)। হু ক্যান বিকাম নেটিভ লাইক ইন আ সেকন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ। অল, সাম, অর নান। স্টাডিয়া লিঙ্গুইস্টিকস, ৫৪ ১৫০-১৬৬/ do
10.1111/1467
Teve] আলি, এম এম (২০০৪) দা কুরআন অ্যান্ড দা ওরিয়েন্টালিস্টস। ইপসউইচ: জামিয়াত ইহুয়া মিনহাজুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা ১৪ (৩৮৪) কেরমানি, কে (২০০৬) পোয়েট্রি অ্যান্ড ল্যাঙ্গোয়েজ, পৃষ্ঠা ১০৮ )
(৩৮৫) উসমানি, এম. টি. (২০০০) অ্যান অ্যাপ্রোচ টু দা কুরআনিক সায়েন্সস, পৃষ্ঠা ২৬১। (৩৮৬) ড্যাজ, এম. এ. (২০০১) দা কুরআন: অ্যান এটার্নাল চ্যালেঞ্জ। অনুবাদ ও সম্পাদনা আদিল সালাহি। লিচেস্টার দা ইসলামিক ফাউন্ডেশান, পৃষ্ঠা ৮৩।
[৩৮৭) লিংস, এম. (১৯৮৩) মুহাম্মাদ হিজ লাইফ বেইসড অন দা আর্লিয়েস্ট সোর্সেস। পরিমার্জিত ২য় সংস্করণ। ক্যাম্ব্রিজ: দা ইসলামিক টেক্সটস সোসাইটি, পৃষ্ঠা ৫৩-৭৯।
[৩৮৮) ইসলামিক অ্যাওয়ারনেস (তারিখ নেই) দা টেক্সট অভ দা কুরআন। http://www.aslamicawareness
org/Quran/Text/ [Accessed 1st October 2016]. (৩৮৯) অ্যারবেরি, এ. জে. (১৯৬৭) পোয়েমস অভ আল-মুতানাব্বি। ক্যাম্ব্রিজ ক্যাম্ব্রিজ
প্রেস, পৃষ্ঠা ১.১৮
য়ুনিভার্সিটি
[১০] এসবের উদাহরণের মধ্যে আছে পিকাসোর শিল্পকর্মের পুনসৃষ্টি। http://www.sohcart.co/artist) Pablo Picasso.html [Accessed 6th October 2016].
(৩৯১) দেখুনঃ টেক্সচুয়াল ইন্টেগ্রিটি অভ দা বাইবেল। http://www.islamicawareness.
org/Bible/Text/ [Accessed 7th October 2016].
(৩১২) কুরআন, ১৮:১০৯
(৩৯৬) মুহাম্মাদ নামটির উল্লেখ আছে ৪ বার। আহমাদ (তাঁর অন্য এক নাম) নামটির উল্লেখ আছে ১ বার। দেখুনঃ http://corpus.quran.com/scarch.jpq=muhammad and http://corpus.quran.com/search.jpp fq=ahmad [Accessed 24th October 2016].
(৩৯৪) “মুহাম্মাদ তোমাদের কারও বাবা নন। সে আল্লাহর বাণীবাহক। নবিদের সিলমোহর। আল্লাহ
সবকিছু জানেন।” কুরআন, ৩৩:৪০
[৩৯৫) কুরআন, ৮১:২২
(৩১৬) কুরআন, ৫৩:২
(৩৯৭) কুরআন, ৪:২৯
(৩৯৮] লিঙস, এম. (১৯৮৩) মুহাম্মাদ হিজ লাইফ বেইসড অন দা আর্লিয়েস্ট সোর্সেস, পৃষ্ঠা ৩৪।
[৩১৯) প্রাগুক্ত।
(৪০০) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৩-৭৯
[৪০১) ওয়াট, ডব্লিউ এম. (১৯৫৩) মুহাম্মাদ অ্যাট মেক্কা। অক্সফোর্ড: অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস,
পৃষ্ঠা ৫২। (৪০২] বুখারি
(80) মুসলিম
(808) মুসলিম
[৪০৫। জারাবোজো, জামালদু-দিন। খণ্ড ১। (১৯৯৯) কমেন্টারি অভ দা ফরটি হাদিথ অভ আন নাওয়াওয়ি। আল-বাশির পাবলিকেশনস অ্যান্ড ট্র্যান্সলেশানস, পৃষ্ঠা ২৭০।
[৪০৬। বুর্জ খালিফা। (২০১৬) ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস। Available at: http://www.burkhalifa.ae/en/thetowet/ factsandfigures.aspx] [Accessed 1st October 2016] [৪০৭) ক্যারিংটন, ডি (২০১৪)। সাউদি আরাবিয়া টু বিল্ড ওয়ার্ল্ডস টলেস্ট টাওয়ার, রিচিং ওয়ান
কিলোমিটার ইন দা কাহ। http://edition.cnn.com/2014/04/17/world/meast/saudi-arabia-to-build
tallest-buildingever/ [Accessed 1st October 2016].
[৪০৮) জাকারিয়া, এ (২০১৫)। দা এটার্নাল চ্যালেঞ্জ: আ জার্নি গ্রু দা মিরাকুলাস কুরআন। লান্ডান
Tags:
কুরআন