ইসলামের বিরুদ্ধে আরেকটি মজার এবং প্রায় অন্তঃসারশূন্য আরেকটি অপপ্রচার হলো এটি।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, যিনি কিনা মদিনার মুনাফিকদের নেতা ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর আল্লাহর রাসূলের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে হাদিসটি দেখিয়ে তারা অপপ্রচার চালায়।
হাদিসবিশারদ কাদের বলবো? যুগের পর যুগে পড়াশুনো করা আলেমগণদের নাকি হঠাৎ দেখেই নিজের ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করা অজ্ঞদের?
যাই হোক, প্রাথমিকভাবে নিম্নোক্ত হাদিসটি দেখায়ঃ
আবূ বাকর ইবনু আবূ শায়বা, যুহায়র ইবনু হারব ও আহমাদ ইবনু আবদা (রহঃ) ... জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনু উবাই এর কবরের নিকট আসলেন এবং তাকে তার কবর হতে উঠিয়ে তার হাঁটুর উপর রাখলেন এবং তিনি তার উপর থুথু দিলেন এবং তাকে স্বীয় জামা পরালেন। আল্লাহই এ সম্পর্কে ভাল জানেন। [1]
সূত্রঃ মুসলিম (ইফাবা) ৬৭৬৮, সহিহুল বুখারী (তাওহীদ) ১২৭০
অবিশ্বাসীদের জন্য দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই হাদিসটি রাসুলুল্লাহ ﷺ
এর পক্ষ থেকে অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণা তো প্রমাণ করতেই পারে না বরং সমগ্র
মানবজাতির প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও সহমর্মিতাকেই ফুটিয়ে তোলে।
উত্তর দেওয়ার আগে জানিয়ে রাখা ভালো, রাসূল (সাঃ) লাশকে ঘৃণা করতেন নাঃ
‘আবদুর রহমান ইবনু আবূ লাইলাহ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাহল ইবনু হুনাইফ ও কায়স ইবনু সা‘দ (রাঃ) কাদিসিয়াতে উপবিষ্ট ছিলেন, তখন লোকেরা তাদের সামনে দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে যাচ্ছিল। (তা দেখে) তারা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদের বলা হল, এটা তো এ দেশীয় জিম্মী ব্যক্তির (অমুসলিমের) জানাযা। তখন তারা বললেন, (একদা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সামনে দিয়ে একটি জানাযা যাচ্ছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলে তাঁকে বলা হল, এটা তো এক ইয়াহূদীর জানাযা। তিনি এরশাদ করলেনঃ সে কি মানুষ নয়?
সূত্রঃ বুখারী (তাওহীদ) ১৩১২, ১৩১১
প্রথমে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি এখানে থুথু দেয়া বলতে ঘৃণা বোঝানো হয়েছে নাকি। হাদিসটির আন্তর্জাতিক অনুবাদ দেখা যাকঃ
Jabir reported Allah's Messenger (+) came to the grave of 'Abdullah b. Ubayy, brought him out from that, placed him on his knee and put his saliva in his mouth and shrouded him in his own shirt and Allah knows best. [2]
Sahih Muslim, 2773a In-Book Reference: Book 51, Hadith 2
USC-MSA web (English) reference: Book 38, Hadith 6678 (deprecated numbering scheme)
আপনাদের চোখে কি স্যালাইভা শব্দটি পড়েছে? এর অর্থ হচ্ছে লালা। একজনের গায়ে
লালা লাগিয়ে দেয়া আর থুথু মারার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। আমাদের
সংস্কৃতি অনুযায়ী কাউকে থুথু দেয়াটা অপমানজনক। ফলে অনুবাদটি পড়লে অজ্ঞতাবশত
ভুল ধারণা হতে পারে। এখানে প্রকৃত পক্ষে লালা মাখিয়ে দেয়াই বোঝানো হয়েছে।
এতোটুকু পর্যন্ত আলোচনার পর তাঁদের অনেকেই আর সুশীলতা ধরে রাখতে
পারেন না। হইহই করে তেড়ে আসেন "তাহলে যারা বাংলা অনুবাদ করেছে, তারা কি ভুল
অনুবাদ করেছে?"
জ্বি না। অনুবাদে ভুল করেন নি কেউই। তবে আপনারা সেই অনুবাদ বুঝতে ভুল
করেছেন।
তারা কেউ সেই অর্থ বিবেচনা করে অনুবাদ করেন নি।
ইসলামিক সেন্টারের অনুবাদ দেখে নিইঃ
৬৮২৩৷ সুফিয়ান ইবনে উইয়াইনা আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি জাবির (রা) কে বলতে শুনেছেন : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মৃত্যুর পর তার কবরের কাছে এসে তাকে কবর থেকে উঠায়ে তাকে নিজ হাঁটুর উপর রেখে নিজ থুথু তার গায়ে মেখে দিলেন এবং নিজ জামা তাকে পরিয়ে দিলেন। [3]
তারপরেও কেউ গাইগুই করতে থাকলে চপোটোঘাত
হিসেবে হাদিসের অনুবাদে উল্লিখিত থুথু শব্দটির মূল আরবি শব্দ 'রিক্ব্' [
ريق ] দেখান। তাদেরকে বলুন তাদের শাইখ গুগল ট্রান্সলেটরে শব্দটি অনুবাদ করে দেখে
নিতে যে অনুবাদে কি স্যালাইভা[৪] দেখায় নাকি অপমানসুচক হিসেবে ব্যবহৃত
থুথু শব্দটির ইংরেজি স্পিট (spit) দেখায়।
(আমরা 'থুথু দিলেন' এটা বিবেচনা করেই আলোচনা করতে পারি!)
তাঁদের নিয়ে একটু হাসাহাসি করুন। হাসাহাসি শেষ করে তাদেরকে
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর ব্যবহার্যের বরকত বোঝান। রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর থুথুর/লালার উপর
আল্লাহ যে সমৃদ্ধি ও বরকত দান করেছেন, তার প্রমাণ অনেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।[5] যেমনঃ
Narrated Yazid bin Abi Ubaid: I saw the trace of a wound in Salama's leg. I said to him, "O Abu Muslim! What is this wound?" He said, "This was inflicted on me on the day of Khaibar and the people said, 'Salama has been wounded.' Then I went to the Prophet (ﷺ) and he puffed his saliva in it (i.e. the wound) thrice., and since then I have not had any pain in it till this hour."
সূত্রঃ বুখারী ৪২০৬
আবূ ইসহাক (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে বারাআ ইবনু ‘আযিব (রাঃ) সংবাদ দিয়েছেন যে, হুদাইবিয়াহর যুদ্ধের দিন তাঁরা চৌদ্দ’শ কিংবা তার চেয়েও অধিক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। তারা একটি কূপের পার্শ্বে অবতরণ করেন এবং তা থেকে পানি উত্তোলন করতে থাকেন। (পানি নিঃশেষ হয়ে গেলে) তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে তা জানালেন। তখন তিনি কূপটির নিকট এসে ওটার পাড়ে বসলেন। এরপর বললেন, আমার কাছে ওটা থেকে এক বালতি পানি নিয়ে আস। তখন তা নিয়ে আসা হলো। তিনি এতে থুথু ফেললেন এবং দু‘আ করলেন। এরপর তিনি বললেন, কিছুক্ষণের জন্য তোমরা এ থেকে পানি উঠানো বন্ধ রাখ। এরপর সকলেই নিজেদের ও আরোহী জন্তুগুলোর তৃষ্ণা নিবারণ করে যাত্রা করলেন।
সূত্রঃ বুখারী ৪১৫১
সাহল ইবনু সা‘আদ (রহ.) হতে বর্ণিত যে, তিনি খায়বারের যুদ্ধের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, আমি এমন এক ব্যক্তিকে পতাকা দিব যার হাতে বিজয় আসবে। অতঃপর কাকে পতাকা দেয়া হবে, সেজন্য সকলেই আশা করতে লাগলেন। পরদিন সকালে প্রত্যেকেই এ আশায় অপেক্ষা করতে লাগলেন যে, হয়ত তাকে পতাকা দেয়া হবে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আলী কোথায়? তাঁকে জানানো হলো যে, তিনি চক্ষুরোগে আক্রান্ত। তখন তিনি ‘আলীকে ডেকে আনতে বললেন। তাকে ডেকে আনা হল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মুখের লালা তাঁর উভয় চোখে লাগিয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি এমনভাবে সুস্থ হয়ে গেলেন যে, তাঁর যেন কোন অসুখই ছিল না। তখন ‘আলী (রাঃ) বললেন, আমি তাদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ লড়াই চালিয়ে যাব, যতক্ষণ না তারা আমাদের মত হয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সোজা এগিয়ে যাও। তুমি তাদের প্রান্তরে উপস্থিত হলে প্রথমে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান জানাও এবং তাদের কর্তব্য সম্পর্কে তাদের অবহিত কর। আল্লাহর কসম, যদি একটি ব্যক্তিও তোমার দ্বারা হিদায়াত লাভ করে, তবে তা তোমার জন্য লাল রংয়ের উটের চেয়েও উত্তম।
সূত্রঃ বুখারী ২৯৪২
আল্লাহর প্রেরিত শেষ নবী মুহাম্মদ ﷺ একজন প্রকৃত মানবদরদী বলেই তাঁর পরম শত্রুদের একজনকে নিজের বরকতময় লালার মাধ্যমে এবং ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। এমনকি তাঁকে নিজের জামাও পরিয়ে দেন।
আসুন ঘটনাটির বাকি অংশ দেখে নিই (যা আপনাকে অজ্ঞরা দেখাবে না, তারা ইচ্ছে করেই অজ্ঞ থাকতে চায়):
গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ৫২/ মুনাফিকদের আচরন এবং তাদের সম্পর্কে বিধান (كتاب صفات المنافقين وأحكامهم)
হাদিস নম্বরঃ ৬৭৭০
৬৭৭০। আবূ বাকর ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) ... ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু উবাই এর মৃত্যুর পর তার ছেলে আবদুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলেন এবং তার পিতার কাফনের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জামাটি চাইলেন। তিনি তাঁকে জামাটি দিয়ে দিলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তার পিতার সালাতে জানাযা পড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালাতে জানাযা আদায়ের জন্য দাঁড়ালেন। এমতাবস্থায় উমার (রাঃ) দাঁড়িয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাপড় চেপে ধরে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তার জানাযা কি আপনি পড়াবেন? আর আল্লাহ তাআলা তার সালাতে জানাযা পড়াতে আপনাকে নিষেধ করেছেন।
(একথা শুনে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ বিষয়ে তো আল্লাহ তাআলা আমাকে ইখতিয়ার দিয়েছেন এবং বলেছেনঃ আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন অথবা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করুন উভয়ই সমান, আপনি সত্তরবার তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি সত্তরেরও অধিকবার আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবো। উমার (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সে তো মুনাফিক ছিল। এরপরও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালাতে জানাযা আদায় করলেন। তখন আল্লাহ তায়াআলা নাযিল করলেনঃ “তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জন্য জানাযার সালাত আদায় করবেন না এবং তার কবর পাশে দাঁড়াবেনও না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih) http://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=19093
হাদিসের এই অংশটুকু খেয়াল করুন, যেখানে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জানাজা পড়াতে গেলে উমর (রাঃ) তাঁকে বারবার মানা করতে থাকেন। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দেন:
হে উমর, তোমার প্রশ্নটা পরে করো। আমাকে যে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে, সেটাই আমি প্রয়োগ করছি। আমাকে বলা হয়েছে 'তুমি তাদের জন্য ক্ষমা চাও বা না চাও (কিছুই আসে যায় না), তুমি যদি তাদের জন্য ৭০ বার ক্ষমা চাও তবুও আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না।' আমি যদি জানতাম যে, ৭০ বারের চেয়েও বেশিবার ক্ষমা চাইলে তাদেরকে ক্ষমা করা হবে, তাহলে আরো বেশি বার ক্ষমা চাইতাম। [6]
এমন একজন মহান ব্যক্তিকে কীভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে অস্বীকার করা যায়, সেটা ওনাদেরকেই ভেবে দেখতে বলুন। যিনি ইবনু ওবাইয়ের গুনাহ মাফের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন, তার দেওয়া থুুুুথু কীভাবে ঘৃণাসূচক হতে পারে?
আর তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জন্য জানাযার সালাত পড়বেন না এবং তার কবরের পাশে দাঁড়াবেন না; তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছিল এবং ফাসেক অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় ইন্তিকাল পর্যন্ত আর কখনো কোন মুনাফিকের জানাযা পড়েননি এবং তার কবরেও দাঁড়াননি। [6]
لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا
রেফারেন্স:
1. মুসলিম ইফা ৬৭৬৮, বুখারি ১২৭০ http://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=19091
2. সহিহ মুসলিম, আন্তর্জাতিক হাদিস নম্বর 2773a https://sunnah.com/muslim:
3. সহীহ মুসলিম, অষ্টম খণ্ড, পৃষ্টা-৩৩৪, প্রকাশনী- বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, হাদিস নম্বর ৬৮২৩
4. Translation of ريق - Google Translate
5. বুখারি ৪২০৬, বুখারি ৪১৫১, বুখারি ২৯৪২
6. মুসনাদে আহমদ ৯৫, https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=62738
লিখেছেনঃ ফারহান হাবীব
সম্পাদনাঃ তাহসিন আরাফাত