স্রষ্টার অস্তিত্ব কি প্রমাণ করার প্রয়োজন আছে?
স্রষ্টাকে অস্বীকার করা, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা
যে কারণে আমাদের স্রষ্টার অস্তিত্বের জন্য প্রমাণ প্রয়োজন নেই
স্রষ্টার অস্তিত্ব কি আছে? এই প্রশ্নটি আমি (হামজা জর্জিস) নাস্তিক একাডেমিকদের সাথে ক্রমাগত আলোচনা করেছি। এই আলোচনাটি প্রায়ই বিভিন্ন বেশে সামনে রাখা হলেও প্রতিজ্ঞা (Premise) সবসময় একই; স্রষ্টার অস্তিত্ব কি আছে এবং এই বিশ্বাসকে সমর্থন করার জন্য কি প্রমাণ আছে?
আদতে, আমি তর্ক করবো যে আমাদের স্রষ্টার অস্তিত্বের জন্য কোনো প্রমাণ প্রয়োজন নেই। তাই প্রশ্নটির স্বয়ং বিতর্ক প্রয়োজন। প্রশ্নটি “স্রষ্টার অস্তিত্ব কি আছে?” হওয়া উচিত নয়, বরং “স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করার জন্য আমাদের কি প্রমাণ আছে?” হওয়া উচিত।
এখন আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি বিশ্বাস করি আমাদের অনেক ভালো যুক্তি রয়েছে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস সমর্থন করার জন্য। যে পয়েন্টটি আমি তুলে ধরছি এখানে, যাহোক, হচ্ছে আমাদের তার অস্তিত্বের জন্য কোনো প্রমাণ প্রয়োজন নেই: স্রষ্টা একটি স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস (Axiomatic belief)। অন্য কথায়, স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বতপ্রমাণিতভাবে সত্য (Self-evidently true)। দর্শনের ভাষায় মৌলিক বিশ্বাস (Basic belief) হিসেবেও পরিচিত। দর্শনে স্বতপ্রমাণিত সত্যের ব্যাপারটি এতো বেশি স্বতপ্রমাণিত, এটি নিয়ে লেখার রেফারেন্স দেওয়া এটি একটি কেমন যেন ব্যাপার। বরং প্রশ্ন হতে পারে অমুক বিষয়টি স্বতপ্রমাণিত কিনা। সহজভাবে বললে, ‘আমি বেঁচে আছি’ – এটি একটি স্বতপ্রমাণিত বিবৃতি (Self-evident proposition)। এই বিবৃতিটি সত্য হওয়ার জন্য কারো স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই।
স্বতপ্রমাণিত সত্যাদির (Self-evident truths) ধারণাটি সবাই স্বীকার করেন। উদাহরণস্বরূপ বিজ্ঞানকে ধরুনঃ বিজ্ঞান বিশ্বের অস্তিত্বকে স্বতপ্রমাণিত সত্য হিসেবে ধরে নেয়; এটি বিশ্বাস করে যে বিশ্ব বাস্তব। অন্য কথায়, ভৌত জগত আমাদের মন এবং চেতনা থেকে আলাদা এবং বহির্ভূত।
এখন আপনি হয়তোবা চিন্তা করছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি বিশ্ব বাস্তব, যেহেতু আমি এটি ছুঁতে এবং অনুভব করতে পারি। আমি বিশ্বাস করি বিশ্ব বাস্তব কারণ অন্য মানুষেরাও বলে যে বিশ্ব তাদের কাছে স্পৃশ্য যেমনটা এটি আমার কাছে।’
যাহোক, এটি কোনো কিছু প্রমাণ করে না। কোনো কিছু ছুঁয়া আর অনুভব করা এটি প্রমাণ করে না যে যা আপনি ছুঁচ্ছেন এবং অনুভব করছেন তা আপনার মন বহির্ভূত। এই চিন্তা এবং অনুভব হতে পারে কেবল আপনার মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ দ্বারা। এটি বিবেচনা করুন; হয়তোবা আপনার মস্তিষ্ক একটি বয়ামে মঙ্গল গ্রহে রয়েছে। সেখানে একটি ভিনগ্রহের প্রাণী রয়েছে যে আপনাকে চিন্তা এবং অনুভব করাচ্ছে যা আপনি অনুভব করছেন এখন।
আপনার কাছে আসলে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ নেই আপনি যে বিশ্বের বাস্তবতার অভিজ্ঞতা লাভ করেন তার জন্য। অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করা প্রমাণ অনির্ভরযোগ্য যেহেতু অভিজ্ঞতাটি কেবল আপনার মস্তিষ্কপ্রসূত হতে পারে। দর্শনের অথবা জটিল যুক্তির উপর ভিত্তি করা প্রমাণও আপনার মনের উপজাত। বহির্বিশ্বের কোনো অস্তিত্ব না থাকতে পারে আপনার খুলিতে কি চলছে তা ব্যতিরেকে।
এটি পড়ার পর আপনি হয়তোবা প্রমাণ দাবি করতে পারেন, প্রমাণ যে বিশ্ব আপনার মস্তিষ্কের বহির্ভূত… কিন্তু আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। আসলে আমাদের তা প্রয়োজন নেই। এই জন্য আমরা বাস্তব বিশ্বে বিশ্বাসকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য (Axiom), স্বতপ্রমাণিত সত্য অথবা একটি মৌলিক বিশ্বাস বলি। অতএব, আমি তর্ক করবো, যে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করা বিশ্ব যে বাস্তব তা অস্বীকার করার সমতুল্য কারণ তাদের উভয়ই স্বতপ্রমাণিত সত্য।
এটি একটি বিশেষ অনুনয়ের (Special pleading) ধরন নয় স্রষ্টার জন্য। কারণ অন্য অগন্য স্বতপ্রমাণিত সত্য এবং স্বতঃসিদ্ধ সত্য রয়েছে যেগুলোতে আমরা বিশ্বাস করি। এগুলো অন্তর্ভুক্ত করে:
অন্যান্য মনের অস্তিত্ব (The existence of other minds)
ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিক মূল্যের অস্তিত্ব (The existence of objective moral values)
যৌক্তিক সত্যাদির অস্তিত্ব (The existence of logical truths)
আমাদের যুক্তির বৈধতা (The validity of our reasoning)
কার্যকারণ সম্পর্ক সূত্র (The law of causality)
স্বতপ্রমাণিত সত্যগুলো, স্বতঃসিদ্ধ সত্যগুলো এবং মৌলিক বিশ্বাসগুলো বহুসাংস্কৃতিক (Cross-cultural) যেন সেগুলো সাংস্কৃতিকভাবে আবদ্ধ নয়। সেগুলো সহজাতও (Innate) যেন সেগুলো কোনো ধরনের তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত নয়, এবং সেগুলো ভিত্তিগত (Foundational)। ভিত্তিগত বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা হলো সেগুলো একটি সুসংগত বিশ্বদর্শনের ভিত্তি প্রদান করে। স্বতপ্রমাণিত সত্যগুলোর এই দিকগুলো এই যুক্তিটির প্রধান আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করার পাশাপাশি আরো ব্যাখ্যা করা হবে।
আপত্তি #১ঃ মস্ত কুমড়া বা স্প্যাগেটি দানবের ব্যাপারে কি বলবেন?
এই যুক্তির কিছু আপত্তি রয়েছে। কিছু নাস্তিক এবং সংশয়বাদী বলবেঃ ‘মস্ত কুমড়া বা স্প্যাগেটি দানবের ব্যাপারে কি বলবেন?’। তারা তুলে ধরে যে যদি স্রষ্টা স্বতপ্রমাণিত সত্য হয়, যদি স্রষ্টা স্বতঃসিদ্ধ হয়, তাহলে কেন স্প্যাগেটি দানব, অথবা মস্ত কুমড়াও স্বতপ্রমাণিত সত্য হতে পারবে না?
এই ভুল আপত্তি নিষ্পত্তি করার তিনটি উপায় রয়েছেঃ
১. একটি বহুসাংস্কৃতিক বিশ্বাস : ‘স্প্যাগেটি দানব’ এবং ‘মস্ত কুমড়া’ প্রাকৃতিক প্রবণতা নয়।[1] ‘স্প্যাগেটি দানব’ বা ‘মস্ত কুমড়া’য় বিশ্বাস করার বিস্তৃত প্রাকৃতিক প্রবণতা নেই। এগুলো প্রাকৃতিক প্রবণতা নয়, এগুলো সাংস্কৃতিকভাবে আবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, আমি যদি একটি স্প্যাগেটি দানবে বিশ্বাস করি, আমাকে এমন একটি সংস্কৃতিতে বড় হতে হবে যেখানে স্প্যাগেটি এবং দানবদের ব্যাপারে শেখানো হয়। কিন্তু, স্রষ্টার ধারণা, একজন মৌলিক অন্তর্নিহিত স্রষ্টার ধারণা, মহাবিশ্বের জন্য একটি অতিপ্রাকৃত কারণের ধারণা, বহুসাংস্কৃতিক। এটি সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল নয়, বরং তা অতিক্রম করে, ঠিক কার্যকারণ সম্পর্ক এবং অন্য মস্তিষ্কে বিশ্বাসের মতো।
২. একটি সহজাত বিশ্বাস : সঠিকভাবে মৌলিক বিশ্বাসগুলো (Properly basic beliefs), স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাসগুলো এবং স্বতপ্রমাণিত সত্যগুলোর তথ্য বিনিময়ের প্রয়োজন হয় না। আমার একটি স্প্যাগেটি দানব কি তা বোঝার জন্য তথ্য বিনিময়ের প্রয়োজন আছে। উদাহরণস্বরূপ, আমার পশ্চিমা রন্ধনপ্রণালী এবং ইতালীয় সংস্কৃতির জ্ঞান প্রয়োজন আছে। কিন্তু যখন মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তাস্বরূপ স্রষ্টার অস্তিত্বের ধারণার কথা আসছে, আমার কোনো তথ্য বিনিময়ের প্রয়োজন নেই, হোক সংস্কৃতি, অথবা শিক্ষা থেকে। এজন্য সমাজবিজ্ঞানীগণ এবং নৃবিজ্ঞানীগণ তর্ক করেন যে যদি নাস্তিক শিশুদেরও জনমানবশূন্য দ্বীপে ছেড়ে দেওয়া হয়, তারা এ বিশ্বাস গঠন করা শুরু করবে যে এই জনমানবশূন্য দ্বীপটি কিছু সৃষ্টি করেছে।[2]
এটি বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরা বারংবার শুনি ‘স্রষ্টা স্প্যাগেটি দানবে বিশ্বাস করার চেয়ে কোনো ভিন্ন নয়’। এটি সত্য নয়। আপনি যদি স্বতপ্রমাণিত সত্যগুলো, স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাসগুলো এবং মৌলিক বিশ্বাসগুলো বোঝেন তাহলে আপনি দেখবেন যে সেগুলোর কোনো তথ্য বিনিময়ের প্রয়োজন নেই। স্রষ্টার মৌলিক ধারণার তথ্য বিনিময়ের প্রয়োজন নেই। এই ধারণার যে দানবের অস্তিত্ব রয়েছে, কিংবা এমনকি যে স্প্যাগেটির অস্তিত্ব রয়েছে, তথ্য বিনিময়ের প্রয়োজন আছে। অতএব, স্প্যাগেটি দানব একটি স্বতপ্রমাণিত সত্য নয়।
৩. একটি ভিত্তিগত বিশ্বাস: তৃতীয় পয়েন্টটি হচ্ছে মৌলিক এবং স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাসগুলো ভিত্তিগতঃ সেগুলো একটি সুসংগত বিশ্বদর্শনের বুনিয়াদ প্রদান করে। সেগুলো প্রশ্ন উত্তর করে এবং জ্ঞান সহজতর করে। উদাহরণস্বরূপ, স্রষ্টার অস্তিত্ব, চেতনার আবির্ভাব ব্যাখা করে, এ ফ্যাক্ট যে বস্তুগত বিশ্বে আমাদের চেতনা আছে।[3] এটি এমন প্রশ্নাদি উত্তর করে যেগুলোর জন্য আমাদের কোনো উত্তর নেই, যেমন ভাষার প্রশ্ন। বর্তমানে, বিবর্তনীয় মডেলগুলো ভাষার ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা করতে পারে না।[4] এটি ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিক সত্যাদির অস্তিত্বও ব্যাখ্যা করে এবং কেন বিভিন্ন ঘটনা সংঘটিত হয় তা ব্যাখা করার জন্য ভিত্তি প্রদান করে।
এটি অন্য একটি স্বতপ্রমাণিত সত্যে প্রয়োগ করা যাক-
আমাদের যুক্তির বৈধতা। আমাদের মস্তিষ্ককে বিশ্বাস করা এবং এই একান্ত ফ্যাক্টটি যে আমরা যুক্তি দিয়ে সত্যে পৌঁছাতে পারি একটি মৌলিক বিশ্বাস। আমরা এ ধরনের বিশ্বাস ধারণ না করলে কিভাবে নিজেদের মস্তিষ্ককে বিশ্বাস করতে পারতাম? আমরা কিভাবে যুক্তি দিয়ে সত্যে পৌঁছাতে পারতাম? আমরা কিভাবে মহাবিশ্ব এবং আমাদের বুঝতে পারতাম? এই প্রশ্নগুলো আমাদের যুক্তির বৈধতার ভিত্তিগত প্রকৃতির ইঙ্গিতবাহী।
স্রষ্টার অস্তিত্ব একটি সুসংগত বিশ্বদর্শনের একটি ভিত্তি প্রদান করে, জ্ঞান সহজতর করে এবং মৌলিক প্রশ্নাদি উত্তর করে। স্প্যাগেটি দানবে বিশ্বাস, অথবা মস্ত কুমড়ায় বিশ্বাস, শুধুমাত্র কিছু হাসির ভিত্তি প্রদান করে।
আপত্তি #২ঃ স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস সার্বজনীন নয়।
একটি প্রধান আপত্তি হলো যেহেতু স্বতপ্রমাণিত সত্যগুলো সার্বজনীন হতে হয়, বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ নাস্তিকের অস্তিত্ব ইঙ্গিত করে যে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বতপ্রমাণিত সত্য নয়। এই আপত্তিটি ভুল, কারণ নাস্তিকদের বিশ্বে বহুসংখ্যা সত্ত্বেও স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস সার্বজনীন। একটি সার্বজনীন বিশ্বাসের অর্থ এই নয় যে বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে তাতে বিশ্বাস করতে হবে। একটি বহুসাংস্কৃতিক ঐক্যমত্য এই দাবিটি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে স্রষ্টার অস্তিত্ব একটি সার্বজনীন বিশ্বাস। উপরন্তু, বিশ্বে নাস্তিকের চেয়ে আস্তিক বেশি রয়েছে, এবং লিপিবদ্ধ ইতিহাসে সবসময়ই এমনটি ছিলো।
নাস্তিক এবং সংশয়বাদীদের এই যুক্তিরূপে উপস্থাপিত বিষয়টি কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করতে হলে, তাদেরকে ব্যাখ্যা করতে হবে যে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বতপ্রমাণিত সত্য নয়। তাদেরকে ব্যাখ্যা করতে হবে যে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস একটি ভিত্তিগত বিশ্বাস নয়, এটি সাংস্কৃতিকভাবে আবদ্ধ এবং এটি শুধুমাত্র তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত।
আমাদের সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাহ)
মৌলিক বিশ্বাসগুলোর, স্বতপ্রমাণিত সত্যাদির এই পুরো ধারণাটি স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ফিতরাহ’র ব্যাপারে। ফিতরাহ একটি আরবি শব্দ যা সারত বোঝায় মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থা, সহজাত প্রকৃতি অথবা সহজাত স্বভাব। এই সহজাত প্রকৃতি স্রষ্টাকে স্বীকার করে এবং তাঁর উপাসনা করতে চায়।[4] যেমনটি রাসূল মুহাম্মদ (সা.) একটি সহীহ হাদিসে বলেছেন যে, ‘প্রত্যেক শিশু জন্মগ্রহণ করে একটি ফিতরাহ’র অবস্থার উপর। তারপর তার বাবা-মা তাকে একজন ইহুদি, একজন খ্রিষ্টান অথবা একজন ম্যাগিআন বানায়…”।[5]
ফিতরাহ’র ধারণাটি ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে এসেছে। চতুর্দশ শতাব্দীর ধর্মতাত্ত্বিক এবং পলিম্যাথ ইবনে তাইমিয়্যাহ ব্যাখ্যা করেছেন যে, “একজন নির্মাতার স্বীকৃতি দৃঢ়ভাবে-বদ্ধ সকল মানুষের হৃদয়ে…এটি তাদের সৃষ্টির বাধ্যবাধকতাপূর্ণ প্রয়োজনীয়তার অন্তর্ভুক্ত…”[6] দ্বাদশ শতাব্দীর আলেম আল-রাঘিব আল আসফাহানি একইভাবে বলেছেন স্রষ্টার জ্ঞান “দৃঢ়ভাবে অাত্মায় বদ্ধ।”[7]
এই সত্ত্বেও, ফিতরাহ’টি হয়ে যেতে পারে ‘আবৃত’ অথবা ‘নষ্ট’ বাহ্যিক প্রভাব দ্বারা। এই প্রভাবগুলো, যেমনটি উপরোক্ত হাদিসটি দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে, অন্তর্ভুক্ত করতে পারে প্যারেন্টিং, সমাজ এবং সমকক্ষ ব্যক্তিদের চাপ। এই প্রভাবগুলো ফিতরাহ’কে মেঘাচ্ছন্ন করে দিতে পারে এবং সত্য স্বীকার করতে বাধা প্রদান করতে পারে। হতে পারে এসবের প্রভাব ফিতরাহ’কে মেঘে ঢেকে দিতে পারে এবং একে সত্য স্বীকারে বাধা দিতে পারে। এই আলোকে ইবনে তাইমিয়্যাহ তর্ক করেন যে যখন কারো প্রাকৃতিক অবস্থাটি “পরিবর্তিত” হয় সে ব্যক্তির প্রয়োজন হতে পারে “অন্যান্য প্রমাণাদি” স্রষ্টার অস্তিত্বের জন্য:
“একজন স্রষ্টা এবং তাঁর পরিপূর্ণতার স্বীকৃতি তার জন্য সহজাত ও প্রয়োজনীয় যার সহজাত প্রকৃতি অক্ষুণ্ণ রয়েছে, যদিও এরূপ একটি স্বীকৃতির পাশাপাশি এর জন্য অন্যান্য অনেক প্রমাণাদিও রয়েছে, এবং প্রায়শ যখন সহজাত প্রকৃতিটি ক্ষুণ্ণ হয়…অনেক মানুষ সেরূপ অন্যান্য প্রমাণাদির প্রয়োজনে থাকতে পারে।”[8]
এই অন্যান্য প্রমাণাদি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে যুক্তিসঙ্গত আর্গুমেন্ট। ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেন যে, একটি উদ্ভূত সত্তা “স্বয়ং জানে স্পষ্ট যুক্তির মাধ্যমে যে এটির একটি উদ্ভাবক রয়েছে”।[9]
তবে এসব যুক্তিসঙ্গত আর্গুমেন্টগুলো অবশ্যই ইসলামী ধর্মতত্ত্ব মেনে চলতে হবে এবং এমন প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে পারবে না যা তার বিরুদ্ধ হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি জেনে রাখা জরুরী যে স্রষ্টায় বিশ্বাস এক ধরনের প্রস্তাবনামূলক (Inductive), ন্যায়িক (Deductive), দার্শনিক কিংবা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থেকে অনুমিত নয়। বরং, এই ধরনের প্রমাণ একটি ট্রিগার হিসেবে কাজ করে ফিতরাহ’কে, স্রষ্টায় বিশ্বাস করার সহজাত প্রকৃতিকে জাগ্রত করার জন্য। এই ছাড়াও, একটি মূল নীতি হচ্ছে কুর’আনীয় যুক্তিগুলো ‘অনাবৃত’ অথবা ‘মেঘহীন’ করে ফিতরাহ’কে। অন্যান্য যেসব উপায়ে ফিতরাহ’কে মেঘহীন করা যায় সেসব অন্তর্ভুক্ত করে ভাবনা, চিন্তা করা, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা এবং আত্মদর্শন। কুর’আন উত্সাহিত করে প্রশ্ন করা এবং গভীরভাবে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করাঃ
“এভাবে আমি চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি।” আল-কুর’আন ১০:২৪
“নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।” আল-কুর’আন ১৬:৬৯
“তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারাই স্রষ্টা?তারা কি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ্বাস করে না।” আল কুর’আন ৫২: ৩৫-৩৬
ফিতরাহ সমর্থনকারী প্রমাণ:
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ফিতরাহ’র ইসলামি ধারণাটি মনস্তাত্বিক, সমাজবিজ্ঞানগত এবং নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। নিচে রয়েছে কিছু সংক্ষিপ্ত উদাহরণঃ
• মনস্তাত্ত্বিক প্রমাণ : একাডেমিক অলিভেরা পেট্রোভিচ মানুষের মনস্তত্ব এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে কিছু গবেষণা পরিচালিত করেছেন। তিনি এই উপসংহারে এসেছেন যে একজন মানববৈশিষ্ট্যের উর্ধ্বে (Non-anthropomorphic) স্রষ্টায় বিশ্বাস হলো মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থা। নাস্তিকতা একটি শেখা মনস্তত্ব।[10] আস্তিকতা আমাদের প্রাকৃতিক অবস্থা।
“এই সম্ভাবনা যে কিছু ধর্মীয় বিশ্বাসাদি হলো সার্বজনীন (উদাহরণস্বরূপ: একজন মানববৈশিষ্ট্যের উর্ধ্বে স্রষ্টায় প্রাকৃতিক জগতের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মৌলিক বিশ্বাস) যতটা ধর্মীয় পাঠ থেকে অনুমান করা যেতো তার চেয়ে বেশী তার পরীক্ষামূলক ভিত্তিই আছে। ধর্মীয় বুঝের উপর গবেষণার কিছু প্রারম্ভিক ফলাফল উন্নয়নমূলক গবেষণার অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যা ইঙ্গিত করে যে মানব জ্ঞানের একাধিক ক্ষেত্রে চেতনাগত সার্বজনীনতা রয়েছে…”[11]
• সমাজবিজ্ঞানগত প্রমাণ: উদাহরণস্বরূপ নিন, অধ্যাপক জাস্টিন ব্যারেট। অধ্যাপক ব্যারেটের রিসার্চ তার ‘বর্ন বিলিভার্স: দ্য সায়েন্স অব চিল্ড্রেন্স রিলিজিয়াস বিলিফ’ বইয়ে শিশুদের আচরণ আর দাবির দিকে তাকিয়েছে। তিনি উপসংহার টানলেন যে শিশুরা জন্মগতভাবে বিশ্বাস করে থাকে তাতে যাকে তিনি ডাকেন “প্রাকৃতিক ধর্ম”। এটি এই ধারণা যে একজন ব্যক্তিবাচক সত্তা (Personal being) আছে যে সমগ্র মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে। সে সত্তা মানুষ হতে পারে না – সেটি অবশ্যই ঐশ্বরিক, অতিপ্রাকৃত হবে।
“শিশুদের উন্নয়নশীল মন এবং অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে শিশুরা স্বাভাবিকভাবে এবং দ্রুত এমন মন অর্জন করে যেগুলো অতিপ্রাকৃত কর্তাদিতে (Supernatural agents) বিশ্বাসাদি সহজতর করে। বিশেষ করে জন্মের পর প্রথম বছরে, শিশুরা কর্তাদি (Agents) এবং অকর্তাদির (Non-agents) মধ্যে পার্থক্য করে, এটা বুঝে যে কর্তাদি উদ্দেশ্যমূলক উপায়ে তাদেরকে চালনা করতে পারে লক্ষ্যাদি অন্বেষণ করতে। তারা উত্সাহী তাদের আশেপাশে এজেন্সি পাওয়ার জন্য, অল্প প্রমাণ সত্ত্বেও। তাদের জন্মের একবছর পরপরই, বাচ্চাদের বুঝতে পারা প্রতীয়মান হয় যে কর্তাদি, কিন্তু প্রাকৃতিক শক্তি কিংবা সাধারণ বস্তু নয়, বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে…এই ফাংশন এবং উদ্দেশ্য দেখার প্রবণতা, প্লাস, একটি বুঝ যে উদ্দেশ্য এবং শৃঙ্খলা মনোবিশিষ্ট সত্তা থেকে আসে, শিশুদেরকে প্রাকৃতিক ঘটনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট হিসেবে দেখাকে সম্ভাব্য করে। কে সৃষ্টিকর্তা? শিশুরা জানে মানুষেরা ভালো প্রার্থী নয় (সৃষ্টিকর্তা হওয়ার)। এটি একজন স্রষ্টা হবে…শিশুরা জন্মগত বিশ্বাসী তাতে যাকে আমি ডাকি প্রাকৃতিক ধর্ম।“[12]
• নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ: কমিউনিস্ট রাশিয়া এবং কমিউনিস্ট চীনের নাস্তিক্যবাদ বিবেচনা করুন।তাদের মধ্যে তখনও এমন কিছুর লক্ষণ ছিল যাকে আপনি বলবেন একটি উপাসনার প্রবৃত্তি, একটি পরিশুদ্ধ হওয়ার প্রবৃত্তি এবং একটি শ্রেষ্ঠতর সত্তার প্রতি সশ্রদ্ধ বিস্ময়, যা ফিতরাতের সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ তাদের স্ট্যালিন এবং লেলিনের বড় মূর্তিগুলো প্রায় পূজাই করা হতো। যখন আপনি বিভিন্ন সংস্কৃতির দিকে তাকাবেন তখন আপনি এই উপাসনার প্রবৃত্তিটি প্রভিাত হতে দেখবেন। এই প্রবৃত্তিটি এমনকি নাস্তিক সংস্কৃতিতেও নিজেকে প্রকাশ করে।
সংক্ষেপে, স্রষ্টাকে অস্বীকার করা বাস্তব বিশ্ব যে আসলে বাস্তব তা অস্বীকার করার মতো। আমরা পূর্বে স্বতপ্রমাণিত সত্যাদি আলোচনা করেছি এবং আমাদের বিশ্বের বাস্তবতা যে তার একটি (তাও আলোচনা করেছি), যদিও আমাদের তার জন্য কোনো প্রমাণ নেই। এজন্যই যদি আপনি স্রষ্টাকে অস্বীকার করেন, যে একটি স্বতপ্রমাণিত সত্য, আপনি স্বয়ং বাস্তবতাকেই অস্বীকার করছেন।
এবং এটি আমাদের প্রিয় রাসূল (সা.)-এর শিক্ষার মাধ্যমে ১৪০০ বছরেরও আগে নিশ্চিত করা হয়েছিলো।
“আসমান-জমীনের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে নিয়ে কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে?” আল-কুর’আন ১৪:১০
তথ্যসূত্র :
[1] Is Belief in God Properly Basic. Alvin Plantinga. Noûs. Vol. 15, No. 1, 1981 A. P. A. Western Division Meetings (Mar., 1981), pp. 41-51. You can find the journal online here: http://www.jstor.org/stable/2215239.
[2] BBC Radio 4 Today, 24 November 2008 http://news.bbc.co.uk/today/hi/today/newsid_7745000/7745514.stm. Accessed 17 December 2014.
[4] “This highlights an important and difficult challenge facing the study of language evolution: the need for cooperation between different disciplines and between researchers working on different aspects of the problem. Without this cooperation a satisfactory account of the evolution of human language, and therefore of human language itself, is likely to be elusive.” ([Prefinal Draft] Kirby, S. (2007). The evolution of language. In Dunbar, R. and Barrett, L., editors, Oxford Handbook of Evolutionary Psychology, pp. 669–681. Oxford University Press.)
[5] Sahīh al-Bukhārī 1292, Sahīh Muslim 2658
[6] Dar’ al-Ta’arud 8/482
[7] al-Dharee’ah p. 199
[8] Majmu’ al-Fatawa 6/73
[9] Nubuwwat, 266
[10] Infants ‘have natural belief in God’. The Age National (Australia) http://www.theage.com.au/national/infants-have-natural-belief-in-god-20080725-3l3b.html. Accessed 17 December 2014.
[11] Key Psychological Issues in the Study of Religion. Olivera Petrovich. psihologija, 2007, Vol. 40 (3), str. 351-363
[12] Justin L. Barrett. Born Believers: The Science of Children’s Religious Belief. Free Press. 2012, pp. 35 – 36.